কিশোর গ্যাং ও মাদকাসক্ত তৈরির স্কুল!
রুদ্র রুহান || রাইজিংবিডি.কম
বরগুনা প্রতিনিধি: চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আসামি ও জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃতদের দুই তৃতীয়াংশই বরগুনা জিলা স্কুলের ছাত্র। সঙ্গত কারণে স্কুলটি এখন অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি।
রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের পর আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয় বরগুনার কিশোর গ্যাং ও মাদক। বের হয়ে আসে হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেয়া ফেসবুকভিত্তিক নয়ন বন্ডের গড়া ০০৭ গ্রুপ ও নেপথ্যে মাদকের ভয়াল সাম্রাজ্য।
দেখা যায়, রিফাত হত্যায় জড়িতদের দুই তৃতীয়াংশই বরগুনা জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছিল। এছাড়াও বর্তমানে অধ্যয়নরতও রয়েছেন দু’জন। তাই বরগুনা জিলা স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সচেতন নাগরিকবৃন্দ।
রিফাত শরীফ হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় নয়ন বন্ড প্রতিষ্ঠিত কিশোর গ্যাং ০০৭ গ্রুপ। নিহত রিফাত শরীফ ও ঘাতক নয়ন বন্ডসহ কিলিং মিশনের মাস্টারমাইন্ড রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী ও হত্যায় অংশ নেয়া অনেকেই এই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া ১৪ জনের ১০জন ও পলাতক চারজনের দু’জন বরগুনা জিলা স্কুল থেকে সদ্য পাশ করা ছাত্র। রিফাত হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার আরিয়ান শ্রাবণ এবছর এ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এছাড়াও গ্রেপ্তার রাতুল সিকদারও বরগুনা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বরগুনার সবচেয়ে পুরনো বিদ্যাপিঠ হিসেবে পরিচিত জিলা স্কুলের ছাত্রদের কেন তবে এই নৈতিক অবক্ষয়। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সরেজমিন অনুসন্ধানে বের হয়ে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য।
বরগুনা জিলা স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে কথা হয় একজন ভাসমান বিক্রেতার সাথে। তিনি গত ১০বছর ধরে এখানে মুখরোচক খাবার বিক্রি করছেন। বললেন, ‘এখানের ছাত্ররা বেপরোয়া, তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে লেগে যায় একে অপরের সাথে। গ্রুপে ভাগ হয়ে একে অপরকে আক্রমন করে। আবার বড় ভাইরা এসে দুই পক্ষকে ডেকে মিটমাট করে দেয়’।
দুপুরের বিরতিতে ফটকের সামনে ভিড় করা কয়েকজন ছাত্রের কাছে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। তারা যা জানান তা এরকম- স্কুল ও ক্লাসে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এর শুরুটা হয়। স্কুলের কেবিনেট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন গ্রুপিং তৈরি হয়। এই গ্রুপিংয়ে বাহুবল প্রদর্শন করতে হয়। আর তখনি বড় ভাইদের স্মরণাপন্ন হয় কেবিনেট নির্বাচনে অংশ নেয়া গ্রুপ লিডার। বড় ভাইয়েরাও সুযোগটা বুঝে নেন ঠিকঠাক। নিজেদের অনুসারি বানাতে সহায়তা করেন ওইসব কিশোরদের।
নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, যারা নেতৃত্বে আসতে চায় তারা প্রায় সবাই কোনো না কোনো বড় ভাইদের সাথে সম্পর্ক রাখে। বিভিন্ন প্রয়োজনে বড় ভাইয়েরা এগিয়ে আসেন। এদের কেউ কেউ মাদকেও জড়িয়ে যায়।
দশম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী জানায়, স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী কথিত বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ রাখে। বড় ভাইয়েরা অনেক ছাত্রকেই মাদকে আসক্ত করে।
জিলা স্কুলের পেছনে দিকে ছাত্রদের থাকার জন্য একটি হোস্টেল আছে। তবে হোস্টেলে শিক্ষক বা ছাত্রদের কেউই থাকেননা। এর ভেতরটা একপ্রকার ‘ভুতের বাড়ি’র মত অবস্থা। এই হোস্টেলের বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শনে ইয়াবা সেবনের নমুনা পাওয়া যায়। এছাড়াও সিগারেটের খালি মোড়ক, দিয়াশলাই ও তার পোড়া কাঠিতে সয়লাব কয়েকটি কক্ষ। হোস্টেলটির ঠিক পশ্চিম দিকে বিদ্যালয়ের পেছনের একটি সরু গলি। ওই পথ ধরে সামনে এগুতেই দেখা যায় তালাবদ্ধ একটি দরজা। দরজাটি দূর থেকে তালাবদ্ধ মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখা যায় এটি একটি কাঠি দিয়ে আটকানো। যে কেউ এটি খুলে বিকল্প আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেখানে একজন ছাত্র’র সাথে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দশম শ্রেণির ওই ছাত্র জানান, এই পথ ধরে বড় ভাইয়েরা হোস্টেলে আসেন। আর ছাত্ররাও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অথবা বিরতিতে এসে একসাথে মাদক সেবন করে দীঘির পাড় ঘেঁষে ওই গলিপথ ধরেই বের হয়ে যায়।
স্কুলের দক্ষিণ দিকে একটি পরিত্যক্ত ভবন রয়েছে। ভবনটি একসময় প্রধান শিক্ষকের বাসভবন ছিল। কিন্তু বেশ কয়েকবছর ধরে ভবনটি পরিত্যক্ত। এর ভেতরের কক্ষগুলোতেও ইয়াবা সেবনের উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
স্কুলটির উত্তর প্রান্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত ভবনের কক্ষে প্রবেশ করে দেখা যায়, নিয়মিতই এ ভবনের কক্ষে ইয়াবা সেবন করা হয় এমন সব নমুনা। গোটা কক্ষ জুড়েই সিগারেটের খালি মোড়ক, দিয়াশলাই, ইয়াবা সেবনের যা যা দরকার হয় সবকিছুরই নমুনা এখানে পড়ে আছে। সেখান থেকে বের হওয়ার পর কয়েকজন উৎসুক অভিভাবকের সাথে কথা হয়। তারা জানান, বিদ্যালয়ের ভেতরে ছাত্ররাও দিনদিন ইয়াবা আসক্ত হয়ে পড়ছে। শহরের কথিত বড় ভাইয়েরা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এদের হাতে ইয়াবা ধরিয়ে দেয়, এখানেই চলে ইয়াবা সেবনের প্রাথমিক কার্যক্রম। এই বড় ভাইয়েরাই ছাত্রদের বিপথগামী করছে। বড় ভাই কারা প্রশ্ন ছিল ওই অভিভাবকদের কয়েকজনের কাছে। তারা জানান, রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত কয়েকজন যারা বিশেষ করে জিলা স্কুলের কিশোরদের টার্গেট করে এসব করছে তাদের ব্যাপারে পুলিশও অবগত। বলে আর লাভ কি, কেউ কিছু করেনা এদের।
রিফাত হত্যার পর মাদক ও গ্যং গ্রুপ যখন দেশে আলোচনার শীর্ষে, তখনও যেন অন্ধকারে বাস করছেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয় কম্পাউন্ডে এমনকি প্রধান শিক্ষকের বাসভবন ও হোস্টেলে মাদকসেবীদের এমন আড্ডার ব্যাপারে কোনো তথ্যই নেই প্রধান শিক্ষকের কাছে। এমনকি কিশোর গ্যাং নিয়ে দেশ তোলপাড় হলেও বিষয়টি তেমন অবগত নন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, ‘মাদক বা কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি আমার জানা ছিলোনা, আমি এ ব্যাপারে এখন থেকে সচেতন হবো। শিক্ষদেরও এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বলবো। আর বাউন্ডারি ওয়াল ও গেটের সংস্কার করা হবে যাতে বহিরাগতরা প্রবেশ করতে না পারে।’
বরগুনা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবির হোসেন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা বিশেষ করে কিশোর গ্যং ও এদের কার্যক্রম ও সার্বিক বিষয় নিয়ে তদারকি শুরু করেছি। শহরের কোথাও যেন এমন গ্যাং গড়ে না ওঠে সেদিকে আমাদের কড়া নজরদারি রয়েছে। মাদক বা গ্যাং কোনটারই বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই, সে যে হোক।’
বরগুনা জিলা স্কুলের মাদকের আখড়া ও কিশোরদের গ্যাংয়ে জড়িয়ে যাওয়া নিয়ে কথা হয় এ স্কুলেরই সহকারি প্রধান শিক্ষক মাহবুব চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, ‘কিশোর বয়সে এরা রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকে। এদের টার্গেট করে মাদক ব্যবসায়ী সংঘবদ্ধ চক্র। কর্পোরেট যুগে পারিবারিক অনুশাসন কমে আসছে। সন্তানদের সময় দেয়া থেকে টাকা দেয়া জরুরী মনে করছেন অনেকে। ফলে বখে যাচ্ছে এরা। শিক্ষকদের একাংশও বানিজ্যিক হয়ে গেছেন। এসব মিলিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বরগুনা জেলার সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, ‘রিফাত হত্যার পর আমাদের অবস্থাটা আয়নায় স্পষ্ট হয়েছে। আমাদের এখন উচিত অসঙ্গতিগুলো নিয়ে কাজ করা। আর এটা করতে ব্যর্থ হলে আমাদের জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যত অপেক্ষমান।’
রাইজিংবিডি/ বরগুনা/৩১ আগস্ট ২০১৯/রুদ্র রুহান/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন