ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

খুলনায় দশ বছরে ১৪ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ!

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খুলনায় দশ বছরে ১৪ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ!

পরিবারের পছন্দে এক কলেজ শিক্ষকের সঙ্গে বিবাহ হয় খুলনার আছিয়া বেগমের (ছন্মনাম)। কিন্তু স্বামী’র সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি নিজেই দাম্পত্য সম্পর্কের ইতি টানেন। এরপর তার জীবন থেকে ঝরে যায় ৭টি বছর, কিন্তু আর সংসার করা হয়নি। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলেও হতাশার মধ্যেই জীবন কাটছে তার।

অপর স্কুল শিক্ষিকা কোহিনুর বেগম (ছন্মনাম) নিজের পছন্দে বিয়ে করেন এক ব্যক্তিকে। কিন্তু সারাক্ষণ স্বামীর সন্দেহ ও পারিবারিক হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি তিনি। যে কারণে তিনিও স্বামীকে তালাক দিয়েছেন।

শুধুমাত্র আছিয়া ও কোহিনুর বেগমই নয়- এভাবে গত ১০ বছরে খুলনা মহানগর এলাকায় অন্তত ১৪ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। মূলত: পারিবারিক বোঝাপড়া ও আস্থার অভাব, নারীদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, ব্যক্তিত্বের অভাব, মাদকের নীল ছোবল, পরকীয়া, একাধিক বিয়ের প্রবণতা এবং অতিমাত্রায় সন্দেহ ও যৌতুকের কারণেই বাড়ছে এ বিচ্ছেদ।

কেউ ভালোবেসে, কেউ পরিবারের সিদ্ধান্তে ঘর বাঁধেন। শুরু হয় একটি সুখের সংসারের গল্প। কিন্তু বুকভরা আশা আর রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে ঘর বাঁধলেও সর্বক্ষেত্রে ধরা দেয় না সুখপাখি। কখনো কখনো মেহেদীর রঙ মোছার আগেই ভেঙে যায় অনেকের সংসার। ফুটফুটে সন্তান ও মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোন কিছুই আটকাতে পারছে না বিচ্ছেদ। তবে, বদলে গেছে তালাকের ধরণ। আগে শতকরা ৭০ ভাগ তালাকের ঘটনা স্বামী কর্তৃক ঘটলেও এখন বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছে নারীরা।

কেসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে এ কর্পোরেশন এলাকায় অন্তত ১৪ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ৯৩২টি, ২০১০ সালে ৯৩৩, ২০১১ সালে ১০৭৪, ২০১২ সালে ১১৮১, ২০১৩ সালে ১২৫৪, ২০১৪ সালে ১৪১৯, ২০১৫ সালে ১৪০৪, ২০১৬ সালে ১৪৮৭, ২০১৭ সালে ১৫৯৫, ২০১৮ সালে ১৭১৯ এবং ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ১০২০টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।

এসব তালাকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তালাক দেয়া পুরুষের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ, আর নারীর সংখ্যা শতকরা ৭০ ভাগ।

খুলনা সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও মনস্তাত্বিক বিশ্লেষক প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী রাইজিংবিডিকে জানান, পারিবারিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব, নারী-পুরুষ উভয়ের ভারসাম্যহীন উচ্চভিলাসী মনোভাব, পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ভাবধারার অনুকরণ, সাংসারিক বন্ধনের প্রতি উদাসীনতা, পারিবারিক অভিযোজনের আপোসহীন মনোভাবের উপস্থিতি ইত্যাদি কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, এ বিচ্ছেদ প্রতিকারে পারিবার গঠন ও পারিবারিক সম্পর্ক তৈরিতে বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিবেকের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন, অপসংস্কৃতিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহতকরণ, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মর্যাদা প্রদান প্রভৃতি মানসিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হৃাস করা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।

কেসিসি’র সচিব আজমুল হক রাইজিংবিডিকে জানান, সমাজে তালাক বা ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো পারিবারিক বোঝা পড়ার অভাব, পরস্পরের মধ্যে নির্ভরশীলতা কম, নারীদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি, ব্যক্তিত্বের অভাব, মাদকের নীল ছোবল, পরকীয়া, একাধিক বিয়ের প্রবণতা, অতিমাত্রায় সন্দেহ ও যৌতুক। তাই এটি প্রতিরোধে সকলকে সচেতন হতে হবে।

মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত, সমাজে নারীদের আত্মমর্যদা, কর্মপরিধি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বেড়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে তারা পেশাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। স্বামীর উপর ভরসা করতে চাননা। এ অবস্থায় পরিবারে সমস্যা তৈরি হলে তারা বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে যাচ্ছেন। উচ্চ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে এ বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি। তবে নারীদের কাছ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসলেও নারীরাই বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কারণ বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে সমাজে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। চরিত্রগত দোষের কথা বলা হয়। আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে গিয়েও নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।

পাশাপাশি এর প্রভাব পড়ছে সন্তানের উপর। তারা বেড়ে উঠছে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে। যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা এক ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে। তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। সমাজ, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে। তাদের মধ্যে জীবন বিমুখতা তৈরি হয়। পারিবারিক অশান্তি, হতাশা ও অপরাধমূলক কাজের প্রবণতায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি হয়।

 

খুলনা/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/বুলাকী

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়