ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শহীদ বন্ধুর মাথার খুলি ৪৮ বছর আগলে রেখেছেন চান্দু

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শহীদ বন্ধুর মাথার খুলি ৪৮ বছর আগলে রেখেছেন চান্দু

১৯৭১ সাল। চারদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত‌্যাযজ্ঞ। আলী আহমেদ চান্দু মিয়া তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। প্রতিদিনের মতো বাবা ডা. ইজাজুল হকের ওষুধের দোকানে হোমিওপ‌্যাথি এবং কবিরাজি চিকিৎসাবিদ‌্যা শিখছিলেন চান্দু মিয়া।

তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান কিশোরগঞ্জ থেকে খবর পেয়ে এলাকাবাসীকে জানান, পাকিস্তানি বাহিনী কটিয়াদী আক্রমণ করবে। দোকান থেকে পালানোর সময় চান্দু মিয়া দেখতে পান, হানাদার বাহিনী কটিয়াদী পৌরসভার পশ্চিম পাড়ায় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালাচ্ছে। এ সময় বিদ্যাসুন্দর দাস, রঞ্জিত দাস, ক্ষেত্র মোহন ঘোষসহ সাতজনকে ধরে নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে তারা। বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃতদেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানি সেনারা। চান্দু মিয়া প্রাণ বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দেন। কচুরিপানায় মাথা আড়াল করে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।

স্বাধীনতার পর ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বন্ধু রঞ্জিত দাস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন কটিয়াদী উপজেলার আলী আহমেদ চান্দু মিয়া। চোখ বন্ধ করলেই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সেই দিনের বিভীষিকাময় দৃশ্য। ১৯৭১ সালে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুচিঁয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় চান্দু মিয়ার বন্ধু ও তার পরিবারের তিন সদস‌্যকে। হত্যার পর দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে রেখে যায় পাকিস্তানি হানাদাররা। বন্ধুর স্মৃতি ধরে রাখতে আজও নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন বন্ধু ও তার পরিবারের তিনজনের মাথার খুলি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আলী আহমেদ চান্দু মিয়া বলেন, দিনটি ছিল শনিবার। খবর পেলাম, পাকিস্তানি বাহিনী কটিয়াদী আক্রমণ করবে। আমি দৌড় দিয়ে পশ্চিম পাড়ায় হিন্দু এলাকায় চলে গেলাম। সেখানে সবাইকে সতর্ক করে বললাম, সবাই পালিয়ে যাও, পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করতে আসছে। কিন্তু সবাই পালাতে পারেনি। তখন আমি আত্মরক্ষা করতে পুকুরে কচুরিপানার নিচে চুপ করে বসে থাকি। এদিকে, পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ আক্রমণ করে। আমার  বন্ধু ও তার পরিবারের কয়েকজনকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, পরে তাদের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর বন্ধু রঞ্জিত দাস, তার বাবা বিদ্যাসুন্দর দাস ও ক্ষেত্র মোহন ঘোষের বিচ্ছিন্ন মাথা চটের ব্যাগে করে নিয়ে আসি। পরে দোকানের পিছনে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে রাখি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাথার খুলি গর্ত থেকে তুলে ধুয়ে-মুছে সযত্নে ঘরে রেখে দেই।

নিহত পরিবারের সদস্য দিলীপ দাস জানান, যুদ্ধের সময় আমাদের বাড়ি পিছন দিক দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। প্রথমে আমাদের ঘরের দরজা লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলে। আমার ভাই রঞ্জিত দাসকে ধরে নিয়ে বুকের মাঝে বেয়নট দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে। তা দেখে আমার বাবা এগিয়ে গেলে তাকেও গুলি করে হত্যা করে। পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। আমার ভাই ও বাবার মাথার খুলি চান্দু ভাই নিজ উদ্যোগে এখনো সংরক্ষণ করছেন। তাদের কথা মনে হলে আমরা প্রায়ই চান্দু ভাইয়ের বাড়িতে যাই। মাথার খুলি দেখে মনে হয়, তারা এখনো আমাদের মাঝেই আছেন।

নিহত পরিবারের আরেক সদস্য শিরু ঘোষ বলেন, প্রায়ই বাবার মাথা খুলি দেখতে চান্দু ভাইয়ের বাড়িতে যাই।

কটিয়াদী চাঁনপুর গ্রামের কলেজছাত্র মো. এনামুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমরা দেখিনি। কিন্তু চান্দু মিয়ার সংরক্ষণে থাকা মাথার খুলি দেখে ও যুদ্ধের সময়ের গল্প শুনে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা উপলব্ধি করতে পারি।

কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্লাহ আল মাসউদ বলেন, চান্দু মিয়া ব্যক্তি উদ্যোগে যে কাজটি করেছেন, সেটি অত্যন্ত প্রশসংনীয়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরতে এ উদ্যোগ অনন্য ভূমিকা পালন করবে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বর্তমান সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাদুঘর নির্মাণের জন্য তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।

প্রতি বছর বিশেষ দিনগুলোতে অনেকেই আসেন গ্রাম্য চিকিৎসক চান্দু মিয়ার কাছে। তারা দেখে যান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার চিহ্ন। চান্দু মিয়ার কাছে থাকা মাথার খুলি ও সেদিনের গল্প শুনে নতুন প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারেন স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা।

চান্দু মিয়ার স্বপ্ন- নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা তুলে ধরার লক্ষ‌্যে মিনি জাদুঘর গড়বেন নিজ বাড়িতে।


কিশোরগঞ্জ/রুমন চক্রবর্তী/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়