ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

শ্রমিক অসন্তোষেই বছর শেষ এবং শুরু...

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০১, ২ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্রমিক অসন্তোষেই বছর শেষ এবং শুরু...

গেল বছরের শুরু থেকেই শিল্পনগরী খুলনায় শুরু হয় পাটকল শ্রমিক আন্দোলন। থেমে থেমে এ আন্দোলন সারা বছর ধরেই চলে। আবার নতুন বছরও শুরু হলো শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যদিয়ে।

১১ দফা দাবিতে খুলনা অঞ্চলের নয় পাটকলের শ্রমিকদের আন্দোলন এখনও অব্যহত রয়েছে। বছরজুড়ে দাবি আদায়ে সভা-সমাবেশ, মিল গেটে বিক্ষোভ, ভুখা মিছিল, সড়ক অবরোধ, মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন শেষে এখন তারা আমরণ গণ-অনশন পালন করছেন।

সূত্র মতে, খুলনা অঞ্চলে মোট রাষ্ট্রায়ত্ত নয় পাটকল রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় রয়েছে সাতটি ও যশোরে রয়েছে দু’টি। পাটকলগুলো হলো- ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল, স্টার জুট মিল, আলিম জুট মিল, ইস্টার্ণ জুট মিল, কার্পেটিং জুট মিল ও জেজেআই জুট মিল। এসব মিলে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক রয়েছে।

গেল বছরের শুরু থেকেই বকেয়া মজুরি প্রদানের দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় খুলনার শিল্পাঞ্চলে। দফায় দফায় সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল আর সভা সমাবেশের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে আন্দোলন। পরবর্তীতে খুলনা এবং ঢাকায় কয়েক দফা বৈঠকের পর আন্দোলন স্থগিত করা হয়। কিন্তু সর্বশেষ বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় শ্রমিকরা এখন অনির্দিষ্টকালের অনশনে রয়েছে।

দাবিসমূহ হল- ১১ দফার মধ্যে বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও পাটকল শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত মজুরি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এ মূহুর্তে আন্দোলনরত শ্রমিকদের মূল দাবি।

এছাড়া পাটের মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পাট কেনার জন্য মিলগুলোকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া, পাটকলে বর্তমানে কার্যকর পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ব্যবস্থা বাতিল করা, বদলি শ্রমিকদের স্থায়ী করা, টার্মিনেশন ও বরখাস্ত সব শ্রমিক-কর্মচারীদের পুনর্বহাল করা, পিচ রেট (ঘণ্টা অনুযায়ী মজুরি) শ্রমিকদের গড় মজুরি দেওয়া, অবসর ও মৃত্যু বীমার পাওনা পরিশোধ করা ( পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকাসহ), নিজ নিজ মিলের পিএফ ফান্ডের টাকা আবার ওই ফান্ডে ফেরত দেওয়া,  শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইবুনালের যে কোনো রায় পুনর্বহাল রাখা, শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে শ্রমিকদের কাজ বন্টন করা এবং  মিলে কর্মচারি নিয়োগ করার ক্ষমতা আবার মিল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের সিদ্ধান্ত বাতিল ও অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকা প্রদান, পাটকলগুলো আধুনিকীকরণের মাধ্যমে লাভজনক শিল্পে পরিণত, পিপিপি’র প্রকল্পে নয় সরকারি উদ্যোগে পাটকলের মেশিন পত্র আধুনিকীকরণসহ উৎপাদন বৃদ্ধি করার দাবিও জানাচ্ছেন আন্দোলনকারী শ্রমিকরা।

শ্রমিক নেতৃবৃন্দ জানান, সরকারি কর্মচারীদের জন্য পে-স্কেল ঘোষণা ও বাস্তবায়ন হয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের জন্য মজুরি কমিশন ঘোষণা হয়েছে ২০১৫ সালে। এমনকি চিনি, খাদ্য, শিল্পসহ অন্যান্য সেক্টরে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পাটকল শ্রমিকদের ২০১৫ সালে ঘোষিত মজুরি কমিশনের রোয়েদাদ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

কর্মসূচি : ১১ দফা দাবিতে গত ১৭ নভেম্বর ৬ দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ। ভূখা মিছিল, মিল গেটে প্রতীকী অনশন ও বিক্ষোভ মিছিল, গেট সভা ও শপথগ্রহণ শেষে ১০ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে নিজ নিজ মিল গেটে আমরণ গণঅনশন শুরু করেন তারা।

সরকারের আশ্বাসে টানা চারদিন আমরণ অনশন কর্মসূচির পর ১৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে কাজে যোগদান করেন তারা। ফলে মিলে উৎপাদন শুরু হয়। তবে, প্রথম দফার অনশন কর্মসূচি চলাকালে আব্দুস সাত্তার ও সোহরাব হোসেন নামে দুজন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে মারা যান। এছাড়া দু’ শতাধিক অসুস্থ শ্রমিককে খুলনা মেডি‌ক‌্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সর্বশেষ অবস্থা :

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান জানান, পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের বিষয় নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর বিজেএমসিতে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে পাটমন্ত্রী, শ্রম প্রতিমন্ত্রী ও বিজেএমসির চেয়ারম্যানের বৈঠকে হয়। বৈঠকে মন্ত্রী ২২ ডিসেম্বর পযর্ন্ত সময় নেন। শ্রমিক নেতারা ২২ ডিসেম্বর পযর্ন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন।

কিন্তু ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুনরায় ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়। ২৬ ডিসেম্বরের বৈঠকে আবারো এক মাসের সময় চান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শ্রমিকরা সরকারের কথার ওপর আস্থা রাখতে না পেরে ২৯ ডিসেম্বর থেকে আবারো আমরণ অনশন শুরু করেন। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

খালিশপুর বিআইডিসি সড়কে গিয়ে দেখা যায়, পিপলস গোল চত্বর থেকে প্লাটিনাম জুট মিলের গেটের কিছুটা পর পর্যন্ত সড়ক বন্ধ করা। সড়কের ওপর তাবু টানিয়ে প্যান্ডেল তৈরি করে তার মধ্যে অবস্থান করছেন শ্রমিকরা। এই সড়কে রয়েছে খুলনার ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, স্টার, খালিশপুর ও দৌলতপুর এই পাঁচটি পাটকলের শ্রমিকরা।

নিজ নিজ মিলের সামনে প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। দুর্বল হয়ে পড়া শ্রমিকদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। প্যান্ডেলে শ্রমিক নেতারা বক্তব্য রাখছেন। তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা।

প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, অনশনে অনেক শ্রমিক স্ট্রোক করেছেন, শতাধিক অসুস্থ হয়ে খুলনা মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমরা প্রয়োজনে রাজপথেই জীবন দিব, কিন্তু দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবো না।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ ননসিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মো. মুরাদ হোসেন জানান, শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে পাটকল শ্রমিকরা সড়কে অনশন করছেন। তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও অনশনে নেমেছেন। যতই দিন যাচ্ছে অসুস্থের সংখ্যা বাড়ছে। ঠাণ্ডাজনিত কারণে প্রায় সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। প্রায় প্রতিটি মিলেই অনশনরত শ্রমিকদের অসুস্থতার সংখ্যা বাড়ছে।

এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টায় সচিবলায়ে পাটমন্ত্রীর সঙ্গে পাটকল শ্রমিক সিবিএ নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকের উদ্দেশ্যে খুলনা থেকে সংগ্রাম পরিষদের আহবায় হামিদুর রহামানের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল খুলনা থেকে রওনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিজেএমসি কর্মকর্তারা বলছেন, কার্যকরী মূলধন না থাকায় কাঁচা পাটের মজুদ নেই। ফলে উৎপাদনও কমেছে। বর্তমানে মিলগুলোয় উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে তাদের লোকসানের পরিমাণ বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উল্লেখ্য, কেবল খুলনা অঞ্চলেই রাষ্ট্রায়ত্ত নয় পাটকলের শ্রমিকদের ১২ থেকে ১৩ সপ্তাহের মজুরি, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাঁচ মাসের বেতন বাবদ প্রায় ৬০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।


খুলনা/নূরুজ্জামান/বুলাকী

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়