ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

সনদ তিনি বুকে আগলে রাখেন সব সময়

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ২৭ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সনদ তিনি বুকে আগলে রাখেন সব সময়

বিচিত্র এই পৃথিবীর বিচিত্র সব মানুষ, আরও বিচিত্র মানুষের স্বভাব-চরিত্র, চালচলন। কখনযে কার মাথায় কি করার ইচ্ছে চেপে বসে, তা বলা মুশকিল। কেউ লম্বা দাড়িগোঁফ, কেউবা লম্বা চুল রাখতে পছন্দ করে। কেউ বাহারি পোশাক পরে সেজেগুজে থাকতে পছন্দ কেরন। কেউবা আবার উদোম গায়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

হ্যাঁ, এমনই একজন মানুষের দেখা মিলবে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার সদরে। তিনি শখের বসে কিনা কে জানে, তবে কনকনে শীতে প্রচণ্ড গরমে কোনো ঋতুতেই গায়ে কাপড় জড়ান না। শুধুমাত্র এক টুকরো গামছা তার একমাত্র পরিধেয় বসন। আর তাও হয়তো লজ্জা নিবারণের জন্যেই।

বয়স আশি ছুঁইছুঁই। তিনি আলফু মিয়া। সবাই তাকে আলফু ফকির নামেই চেনেন। কে জানে ফকির নামের আড়ালেই কিনা চাপা পড়ে আছে তার আরেকটি বড় পরিচয়! আর সেই পরিচয়টি হলো, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে রয়েছে তার সাহসীপূর্ণ ভূমিকা। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাক্কালে দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ এর ভয়াবহ যুদ্ধের কথা অনেকেরেই জানা।

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবার পর ৩১ মার্চ জাফরগঞ্জ হানাদার বাহিনীর সাথে নিরস্ত্র বাঙালিদের মুখোমুখি সংঘর্ষে শহীদ হন ৩৩ জন বীর বাঙালি।  সে সময় নিহত হয় ১৫ জন হানাদার সদস্যও। টগবগে তরুণ আলফু মিয়াও হানাদারের গুলির আঘাতে আহত হন।

আলফু মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার বয়স ছিল ২৮ বছর। তখন জাফরগঞ্জ বাজারে একজন সাধারণ পান দোকানি আমি। ৩১ মার্চ একদল সশস্ত্র হানাদার বাহিনী জাফরগঞ্জ আসার পর স্থানীয় হাজারো জনতা তাড়া করে তাদের।এসময় ২৮ বছরের তরুণ এই আমিসহ (আলফু মিয়া) স্থানীয় জনতা কৌশলে সৈন্যদের ঘেরাও করি। পাকহানাদার সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে দৌড়ে গিয়ে শ্রী পুকুরপাড় পশ্চিম মসজিদের ভেতর আশ্রয় নেয়। এসময় মসজিদের দরজা জানালা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আলফু মিয়া বলেন, তখন আমি টগবগে তরুণ। সবার সাথে আমিও অংশ নেই হানাদার নিধনে। শুকনা মরিচের বস্তায় আগুন লাগিয়ে কেরোসিন ঢেলে পাক সৈন্যদের কাবু করি। এদিকে হানাদার সদস্যরাও গুলি করতে থাকে নিরস্ত্র বাঙালির জনতার ওপর। একপর্যায়ে হানাদাররা আত্মসমর্পণে বাধ্য হলেও, ইতিমধ্যেই তাদের গুলিতে শহীদ হন ৩৩ নিরস্ত্র বাঙালি।

আলফু মিয়া বলেন, রেহাই পায়নি আমিও। হানাদারদের ছোঁড়া বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আমার ডান বাহু। বিচূর্ণ হয়ে যায় হাঁড়। অপর দুজনের গুলি যেহেতু পেটে ও বুকে লেগেছিল তারা পরবর্তীতে মারা যান।

তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়ে তখন কোন ডাক্তার আহতদের চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। আমি বিভিন্ন গাছের পাতা গুলিবিদ্ধ ডান বাহুতে পেঁচিয়ে কোন রকমে নয়টি মাস পার করি। পরে কুমিল্লায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। অবশেষে আংশিক সুস্থ হলেও পূর্ণাঙ্গ শক্তি ফিরে পাইনি এই হাতের।

আলফু মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, নয় মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও পরবর্তীতে অনেকে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব, সম্মানি ভাতা ভোগ করছেন। অথচ অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার মূল্যায়ন হয়নি।

দেবিদ্বার উপজেলার বাজেবাখর নগর গ্রামের প্রয়াত চান মিয়া এবং চন্দ্রবান বিবির ছেলে আলফু মিয়া। জাফরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের একটা সনদ ছাড়া তার কাছে আর কোন দলিল নেই। এ সনদ তিনি বুকে আগলে রাখেন সব সময়। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজ নামটি দেখতে চান এই যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।

 

কুমিল্লা/ইমরুল/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়