ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সহযোদ্ধাদের জন্য আজও মন কাঁদে

শাহরিয়ার সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৯, ৩১ মার্চ ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সহযোদ্ধাদের জন্য আজও মন কাঁদে

মো. শামসুল আলম খান। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে পরিবারের নিষেধ সত্বেও বাড়ি থেকে পালিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতে। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন নিজ এলাকায়।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও, এখনও সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে শামসুল আলমের। মনে পড়ে যুদ্ধের ময়দানে পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হওয়া সহযোদ্ধাদের কথা।

রাইজিংবিডির সাথে আলাপকালে শামসুল আলম খান স্মৃতিচারণ করেছেন সেই সব দিনগুলোর।

টাঙ্গাইলের বাসাইলের বাথুলি গ্রামের মো. আবুল কাশেম খানের ছেলে শামসুল আলম খান। পাঁচ ভাই, তিন বোন। তিনি ছিলেন পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। ১৯৭১ সালে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ছিলেন ২১ বছরের তরতাজা যুবক।

১৯৭১ সালের ৭মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিলে শামসুল আলম ঠিক করেন তিনি যুদ্ধে যাবেন। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশ স্বাধীন করবেন।

ছেলের মুখে এমন কথা শুনে আঁৎকে ওঠেন তার মা। কিন্তু দেশের জন্য ছেলের এমন ইচ্ছায় সায় দেন বাবা আবুল কাশেম। স্ত্রীকে বোঝান ছেলেকে বাধা না দিতে। কিন্তু মমতাময়ী মা অজানা আতঙ্কে ছেলেকে আটকে রাখেন। ‍যুদ্ধে যাওয়া আটকাতে খবর দেন বড় ছেলেকে।

তখন তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে, পুলিশে কর্মরত। ছোট ভাইকে যুদ্ধে যাওয়া আটকাতে শামসুল আলমের বড় ভাই টানা এক মাস হেঁটে বাড়ি চলে আসেন। ছোট ভাইকে বোঝান যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে। সে সময় শামসুল আলমের মন ফেরাতে সারাদিন তাকে নিয়ে তাস খেলতেন তার বড় ভাই।

তারপরও ঠেকানো যায়নি। ১৯৭১ সালের ১৭মে কয়েক বন্ধু মিলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে শামসুল আলম চলে যান ভারতে। সেখানে প্রশিক্ষণ নেন অস্ত্র চালানোর। রপ্ত করেন যুদ্ধের নানা কৌশল।

জুন মাসের শেষে দিকে ২৮ জনের একটি দলের সাথে শামসুল আলম ময়মনসিংহ-জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। দেশে প্রবেশ করেই পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তারা। ময়মনসিংহ জেলায় চারটি যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রবেশ করেন টাঙ্গাইলে।

টাঙ্গাইলে প্রবেশ করেই শামসুল আলম ও তার সহযোদ্ধারা ছড়িয়ে পড়েন পুরো জেলায়। ছোট একটি দলের সাথে আরও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করতে তিনি চলে যান নিজ গ্রাম বাসাইলে। সেখানে বড় একটি যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। নথখোলা-কাশিল সীমান্তে সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন পাঁচ জন মুক্তিযোদ্ধা।

সেই যুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে শামসুল আলম বলেন, ‘‘পাক বাহিনীর আসার খবরে নথখোলা নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থান নেন তারা। আর পশ্চিম পাড় দিয়ে এগিয়ে আসে পাক হানাদার বাহিনী। সেই যুদ্ধে মুক্তিকামী আর হানাদার বাহিনী দুই দলের মধ্যে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে নিহত হয় অনেক সাধারণ মানুষ। নিহত হয় অনেক পাকসেনাও।

‘সেই যুদ্ধে নাজির নামে প্রিয় এক সহযোদ্ধা বন্ধু হারিয়েছিলেন শামসুল আলম। যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে তার পাশে থেকেই যুদ্ধ করছিলেন নাজির। হঠাৎ পাক বাহিনীর ছোড়া একটি গুলি এসে লাগে নাজিরের শরীরে। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি।”

প্রিয় বন্ধু আর সহযোদ্ধাকে চোখের সামনে হারানোর সেই স্মৃতি এখন তাড়িয়ে বেড়ায় শামসুল আলমকে।

সেই যুদ্ধে পিছু হটে পাক বাহিনী রওনা হয় বাসাইলের দিকে। পথে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চালায় নারকীয় হত‌্যা ও ধ্বংস্বযজ্ঞ। নির্বিচারে হত্যা করে সাধারণ মানুষদের। আগুন লাগিয়ে দেয় বসত ভিটায়। পরে চারদিকে মুক্তিবাহিনী ঘিরে ফেলায় বেসামাল হয়ে পড়ে পাক বাহিনী। সামনে এগোনোর একমাত্র পথ ছিল নদী। তাই হার স্বীকার করে নেয় তারা।

এই অকুতভয় মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘ডিসেম্বরের ৯ তারিখে ভারতীয় মিত্র বাহিনী আকাশপথে এসে নামে টাঙ্গাইলে। তারপরই তারা পাক বাহিনীর উপর মর্টার শেল হামলা চালায়। ভারতীয় মিত্র বাহিনী আর দেশীয় মুক্তিবাহীর যৌথ আক্রমণে দিশেহারা পাক বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটে তারা।

সেসময় শাহ আলম নামের এক প্রিয় সহযোদ্ধাকে হারান শামসুল আলম। শাহ আলম আর শামসুল আলম সবসময় একসাথে থাকতেন। এক প্লেটে খেতেন খাবার। সেই বন্ধুকে হারানোর স্মৃতিও তাকে আবেগাপ্লুত করে তোলে।

তিনি বলেন, ‘১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল স্বাধীনের একদিন আগে, জীবত এক হানাদারকে ধরতে গিয়েছিলেন তার সেই বন্ধু শাহ আলম। তার দিকে বন্দুক তাক করার পর হাত উঁচু করে প্রাণ ভিক্ষা চায় সেই হানাদার। তখন বন্দুক তাক করে রেখে সেই হানাদারের কাছে যায় শাহ আলম। সে সময় আগে থেকে লোড করে রাখা স্ট্যান্ডগানে পা দিয়ে চাপ দেয় সেই হানাদার। আর এতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শাহ আলমের শরীর। নিজ জেলা স্বাধীন হবার একদিন আগে শহীদ হন তিনি।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এইচএসসি আর ১৯৭৫ সালে বিকম পাশ করেন শামসুল আলম। কয়েক বছর পর যোগ দেন বিডিআরে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর ধরাবাধা নিয়মে মন টেকেনি শামসুল আলমের।

১৯৮২ সালে সেই চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন জনতা ব্যাংকে। সেখানে এক বছর চাকরি করার পর সেটাও ছেড়ে দেন। পরে ১৯৮৬ সালে পাড়ি জমান জাপানে। সাত বছর প্রবাস জীবন কাটানোর পর ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে ফিরে আসেন নিজ দেশে।

এরমধ্যেই চাকরি সূত্রে কোরিয়া, হংকং, তাইওয়ান, চীনসহ ১১টি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। দেশে ফেরার পর আবারও বিদেশে পাড়ি দিতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার।

ছেলেকে ঘরে আটকাতে বিয়ে দিয়ে দেন মা। তারপর আর দেশ ছাড়া হয়নি শামসুল আলমের। টাঙ্গাইল শহরে সারের ডিলারশিপ নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা।

ব্যক্তি জীবনে শামসুল আলম এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। বড় ছেলে প্রিন্স খান হাফেজ। পেশাগত জীবনে তিনি ব্যবসায়ী। মেয়ে পড়ছেন মেডিকেলের শেষ বর্ষে।

শামসুল আলমের অবসর কাটে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ আর বাড়ির ছাদে কবুতর পালন করে। সময় পেলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও বসেন তিনি। তবে মন পড়ে থাকে প্রিয় বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের কাছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যারা এক সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন করেছেন।




সিফাত/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়