জিপিএ-৫ পেয়েও প্রিয়ার মুখে হাসি নেই
প্রিয়া রানী পাল। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু এরপরও তার মুখে হাসি নেই। শঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় দিন পার হচ্ছে তার।
হবে না কেন? প্রিয়া রানী পালের গৃহ পরিচারিকা মায়ের তিনবেলা তিন মুঠো খাবার যোগার করা যেখানে অনেক কষ্টের সেখানে এসএসসি পাশের পর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হবার স্বপ্ন এক রকম বিলাসিতা।
বলছিলাম বাগেরহাট সদর উপেজেলার গোমতী গ্রামের মেধাবী প্রিয়া রানী পালের কথা। চরম দারিদ্রতা আর বৈরি পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা প্রিয়া রানীর ঘরে নুন আনতে পানতা ফুরায়। মায়ের ঝুপড়ি ঘরে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বড় হয়েছে সে। তার পরেও হাল ছাড়েননি সে। অভাব তাকে দমাতে পারেনি। তার প্রমাণও দিয়েছেন এবারের এসএসসি পরীক্ষায়। জিপিএ-৫ পেয়ে তিনি এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছন।
জন্মের পর থেকে বাবা ছাড়া মা অঞ্জনা রানী পালের সঙ্গে প্রিয়া মন্দিরের জমিতে ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। অন্যের বাড়িতে কাজ করে এবং স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি করে চলে মা মেয়ের সংসার। এর মধ্যে মেয়ে বড় হতে থাকে। অঞ্জনার স্বপ্নও বড় হয়। নিজের কথা চিন্তা না করে মেয়ের লেখাপড়ার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন মা। মেয়েও দারিদ্রতা ও স্থানীয় সকল বাঁধা বিপত্তিকে পেছনে ফেলে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। এরপর প্রিয়া রানী পাল বাগেরহাট সদর উপজেলার শরৎচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পান। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে শঙ্কায় জনম দুঃখী মা অঞ্জনা রানী ও মেয়ে প্রিয়া রানী পাল। কারণ চিন্তা এখন উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির টাকা কোথায় পাবেন?
এলাকার অন্য অভিভাবকরা সন্তানের সাফল্যে যখন মিস্টি বিতরণে ব্যস্ত। তখন মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির টাকার চিন্তায় অঞ্জনা রানীর চোখে ছলছল করছে পানি।
অঞ্জনা রানী পাল বলেন, ‘পারিবারিকভাবে বাগেরহাট সদর উপেজেলার গোমতী গ্রামের প্রদীপ কুমার পালের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পরই আমার কোল জুড়ে আসে প্রিয়া। কিন্তু সন্তান আসার পর থেকেই স্বামী আমার অচেনা হয়ে যায়। কিছুদিন পরে আমাকে ও মেয়েকে ফেলে রেখে ভারতে চলে যায়। আর ফেরেনি। শুনেছি সেখানে নাকি একটা বিয়ে করেছে। স্বামী চলে যাওয়ার পরে স্বামীর ঘর থেকেও নামিয়ে দেয় শ্বশুর বাড়ির লোকজন। পরে গোমতি সার্বজনীন বাসন্তি মন্দিরের বারান্দায় থাকতাম। এরপর স্থানীয়দের সহযোগিতায় ওই মন্দিরের জায়গায় ঝুপড়ি ঘর করে থাকি। মানুষের বাড়িতে কাজ করি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় বাগান ও ঘেরের পাড় থেকে সবজি তুলে বিক্রি করে মা-মেয়ে কোন মতে বেঁচে আছি।’
অঞ্জনা আরও বলেন, ‘বেশিরভাগ দিন আমরা তিন বেলা খেতে পারিনা। এক বেলা খাবার জুটলে অন্য বেলারটা নিয়ে চিন্তায় থাকি। অনেকে বলেছে তোর ঘর নেই, জমি নেই মানুষের বাড়ি কাজ করিস। মেয়েকে পড়িয়ে কি করবি। এর মধ্যেও মেয়ে আমার পড়াশুনা করেছে। মেয়েকে কোন প্রাইভেট দিতে পারিনি। তারপরও মেয়ে আমার এ প্লাস পেয়েছে। কিন্তু আইয়ে ভর্তির টাকা কোথায় পাব আমি! সেই চিন্তায় আর খুশি হতে পারিনা। মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করছি।’
মেধাবী প্রিয়া রানী পাল বলেন, ‘বাবাকে কবে দেখেছি তা মনে নেই। বাবার কথা জানতে চাইলে মা বলতেন লেখাপড়া করে মানুষ হও বেঁচে থাকলে বাবা একদিন খোঁজ নিবে। না খেয়ে থেকেছি। কিন্তু কখনও স্কুলে যাওয়া বন্ধ দেইনি। স্কুলের স্যাররাও আমাকে সহযোগিতা করেছেন। মায়ের প্রেরণায় সব সময় লেখাপড়া করেছি। আমি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাই। এ জন্য সকলের সহযোগিতা চাই।’
শরৎচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আছাদুল কবির বলেন, ‘প্রিয়া অনেক মেধাবী। কিন্তু তাদের থাকার ঘরও নেই বলা যায়। মানুষের বাড়িতে কাজ করে মেয়েকে স্কুলে পড়িয়েছে তার মা। এসব কারণে প্রিয়ার কাছ থেকে কখনও স্কুলের বেতন ও পরীক্ষার ফি নেইনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও আমরা শিক্ষকরা সব সময় প্রিয়াকে সহযোগিতা করতাম। মেয়েটি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশের মান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।’
ভবিষ্যতেও প্রিয়া যাতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে মায়ের দুঃখ ঘোচাতে পারে সে জন্য পাশে থাকার আশা ব্যক্ত করেন এই শিক্ষক।
বাগেরহাট/বুলাকী
রাইজিংবিডি.কম