একের পর এক প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল, সিলেটে বন্যা আতঙ্ক
টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। সুরমা এবং সারি নদীর দু’টি পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে।
পানি বাড়ার কারণে নদী তীরের তিনটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে সারি-গোয়াইনঘাট সড়কসহ গ্রামীণ অনেক সড়ক। এ কারণে শুক্রবার (২৬ জুন) বিকেল থেকে উপজেলা সদরের সাথে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, সুরমার কানাইঘাট পয়েন্ট এবং সারি নদীর সারিঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাশাপাশি সুরমার সিলেট পয়েন্ট, কুশিয়ারার আমলশীদ, শেওলা, শেরপুর এবং ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্ট ও সীমান্ত নদী লোভাছড়া এবং পিয়াইন নদের পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উজানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে আগামী ২৪ ঘন্টায় এসব পয়েন্টের পানি আরও বাড়বে। একই সাথে নতুন করে অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে।
শুক্রবার (২৬ জুন) সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার এবং সারি নদীর সারি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে পানি সুরমার সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারার আমলশীদ পয়েন্টে ৯৭ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ১৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এছাড়া লোভাছড়ায় সর্বশেষ ১২ ঘন্টায় ১০৪ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে।
একই সাথে কানাইঘাটে গত ২৪ ঘন্টায় ৫৭ মিলিমিটার, সিলেটে ২৭ মিলিমিটার, বিয়ানীবাজারের শেওলায় ২১ মিলিমিটার এবং শেরপুরে ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘সিলেটে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুসারে আরও দুইদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এছাড়া উজানেও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এ কারণে নদী তীরের উপজেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল পানিতে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’
শুক্রবার রাত ১২টার দিকে গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মনজুর আহমদ জানান, সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ার কারণে পাহাড়ি ঢল নামলেই এ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে তিন-চারদিন উপজেলার প্রায় ৫০ এর অধিক গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছিল। বন্ধ হয়ে পড়েছিল উপজেলা সদরের সাথে সড়কপথে যান চলাচল। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল। এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই ফের দ্বিতীয় বারের মতো উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।
তিনি জানান, পাহাড়ি ঢলে সারি ও পিয়াইন নদীর পানি দুই তীর উপচে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের জাফলং চা বাগান, বাউরবাগ হাওর, আসামপাড়া হাওর, পুর্ব আলীরগাঁও ইউনিয়নের নাইন্দা, তীতকুল্লি, বুধিগাঁও, খাস, দাড়াইল, বাংলাইন ও লাতু হাওর, পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নের সাতাইন, পাঁচপাড়া, পুকাশহাওসহ উপজেলার বিভিন্ন হাওর এলাকার গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে শতাধিক মৎস খামারের মাছও। এছাড়া সারি-গোয়াইনঘাট সড়ক ও গোয়াইনঘাট- জাফলং সড়ক দিয়ে যান চলাচলও বন্ধ আছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুস সাকিব জানান, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। ইতোমধ্যে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক তথ্য প্রদানের জন্য সকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জৈন্তাপুরের স্থানীয় সংবাদকর্মী এম এম রুহেল জানান, জৈন্তাপুরের সারি নদী তীরের তিনটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বড়গাং, শ্রীপুর, রাংপানি নদীর পানিও বেড়েছে। পানি বাড়ার কারণে অনেক গ্রামীণ রাস্তা নিমজ্জিত হয়েছে। যে কারণে চলাচল বন্ধ আছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে; ফলে রাতে কিছু এলাকায় পানি বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন মানিক জানান, উপজেলা প্রশাসন'র পক্ষ হতে সার্বক্ষনিক মনিটরিং করা হচ্ছে। পানিতে প্লাবিত এলাকাগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে ।
কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় সংবাদকর্মী আবিদুর রহমান জানান, সীমান্ত নদ ধলাইর পানি বেড়ে উপজেলা সদরসহ নিম্নাঞ্চলের একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়ায় জনসাধারণের মাঝে দুর্ভোগও বাড়ছে। এছাড়া বন্যা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
এদিকে কানাইঘাট উপজেলায় সুরমা ২৯ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার লোভা নদীর পানিও বাড়ছে হু হু করে। এ কারণে উপজেলার ১ নং লক্ষী প্রসাদ পূর্ব, ২ নং লক্ষী প্রসাদ পশ্চিম, ৫ নং বড় চতুল, কানাইঘাট পৌরসভা, ৯ নং রাজাগঞ্জ, ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বারিউল করিম খান।
গত বুধবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে সিলেটে। একই সাথে সীমান্তের ওপারেও বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, পিয়াইন, ধলাইয়ে নামছে ঢল। আর এ ঢলেই প্লাবিত হচ্ছে নিম্বাঞ্চল। বৃষ্টিপাত আরও দু’তিনদিন থাকবে বলে পূর্বাভাসে জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। এ কারণে করোনার দুর্ভোগে নতুন করে বন্যার আতঙ্কে আছেন মানুষ।
সিলেট/ নোমান/টিপু
রাইজিংবিডি.কম