ঢাকা     শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১৩ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষিত এক দৃষ্টিহীন দম্পতির কষ্টগাঁথা

গাজী হানিফ মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৩ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
উচ্চশিক্ষিত এক দৃষ্টিহীন দম্পতির কষ্টগাঁথা

রফিকুল ইসলাম ও শাহিদা আফরোজ মীম দৃষ্টিহীন দম্পতি।  দু'জনই উচ্চশিক্ষিত।  একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করেন অনার্স-মাস্টার্স।  বিয়ে করেছেন ভালোবেসে।

এখন এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছোট একটি সংসার তাদের।  তবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের নেই কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।

সংসার জীবনের শুরুতে এতদিন আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় কোনমতে খেয়েপড়ে থাকলেও মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের পর দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন।  কারণ স্বজনরাই এখন চলতে হিমসিম খাচ্ছেন।  বর্তমানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এ দম্পতির দিন কাটছে এক বেলা খেয়ে না খেয়ে।

নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের দাসপাড়ায় দেখা হলো দৃষ্টিহীন এই দম্পতির সাথে।  সেখানে ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন থাকছেন তারা।   বললেন তাদের জীবনের গল্প।  জানালেন তাদের কষ্টে যাওয়া বর্তমান সময়ের কথা।

এ দম্পতি জানায়, লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছেন।  অনেক ব্যাংকেও  আবেদন করেছেন।  কিন্তু ফলাফল শূন্য।  কোন দপ্তরেই মিলেনি তাদের চাকরি।  আলোহীন চোখ নিয়ে দুজনেই দেশের খ্যাতনামা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলেও চাকরি না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় অন্ধকার নেমে আসে তাদের সংসার জীবনে।

শিক্ষা জীবন শেষ করার পর থেকেই চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা দুজনেইএখন ক্লান্ত।  এ দম্পতির আবেদন শুধু মাত্র একটি চাকরির।  যার সুবাদে তিন বেলা খেয়েপড়ে তাদের ছেলে-মেয়েটিকে মানুষ করতে পারেন।

নরসিংদী রায়পুরা উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের ফুলদী গ্রামের রফিকুল ইসলাম দৃষ্টি হারান তিন বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে।  নোয়াব আলী মোল্লার পাঁচ সন্তানের মধ্যে রফিকুল তৃতীয়।  গাজীপুরের নীলের পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি, ২০০৭ সালে শহীদ এম মনসুর আলী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।  পরে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স পাস করেন।

শাহিদা আফরোজ মীম এর জন্ম চাঁদপুরের হাইমচরে।  তাদের পাঁচ বোন ও এক ভাই।  নদী ভাঙ্গনে তাদের সব কিছু বিলীন হয়ে গেলে তার পিতা আব্দুল আজিজ সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়।  এ সুবাদে শৈশব কাটে তার ঢাকার মিরপুরে।  মীমও বয়স যখন তিন বছর তখন হামের কারণে দৃষ্টি হারান।  বয়স যখন ১১ বছর তখন পিতাকেও হারান।  তারপরও থেমে থাকেননি তিনি।

মীম মিরপুরের আইডিয়াল স্কুল এন্ড গার্লস কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এসএসসি, ২০০৫ সালে বেগম বদরুন্নেসা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।  এরপর ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ থেকে অনার্স ও ২০১১ মাস্টার্স করেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে এক সিনিয়র ভাইয়ের স্ত্রীর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মীমের সাথে যোগাযোগ হয় রফিকুলের।  এরপর পরিচয়।  এ পরিচয় থেকে প্রেম-ভালোবাসা।  সে ভালোবাসার টানে ২০১১ সালে বিয়ে হয় মীম-রফিকুলের।

২০১৪ সালে তাদের ঘর আলো করে আসে ছেলে শামিউল ইসলাম সিয়াম।  তার বয়স এখন ৬ বছর।  পড়ছে সানবীম নামে একটি স্কুলের প্লে গ্রুপে।  ২০১৯ সালে জন্ম নেয় মেয়ে জান্নাতুল ফাতেমা।

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক সময় বাবার সহযোগিতায় চলতাম।  ২০১৫ সালে বাবা মারা যান।  এরপর থেকে আমার অন্ধকার জীবনে নেমে আসে আরো অন্ধকার।  ভাবতে হচ্ছে দু'মুঠো আহারের কথা, দুই সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা।  যদি একটি চাকরি ব্যবস্থা হয় তাহলে দু'মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে হয়ত এ সন্তান দু'টিকে মানুষ করতে পারতাম।  তা না হয়তো অন্ধকার ভুবনে অন্ধকারই থেকে যাবে। '

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রফিকুল বলেন, ‘এখন পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে, আর পারছি না।  যদি কোন হৃদয়বান ব্যক্তি আমাদের সহযোগিতা করেন বা একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতেন, যা দিয়ে জীবন চলার পথ হবে আমাদের। '

মীম বললেন, ‘জীবনে কখনো ভাবিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেও চাকরি পাব না।  ২০১১ সাল থেকে আমরা দুজন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চেষ্টা করেই যাচ্ছি।  এখন আমাদের জীবনটা খুব কষ্টে কাটছে। মাসে সংসার চালাতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে।  কিন্তু আমাদের কোনো আয় নেই। '

মীম বলেন, ‘এমন যদি কেউ থাকতো আমাদের একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে সাহায্য করতেন।  আর তা না হলে দুই সন্তান নিয়ে মরতে হবে।  এছাড়া কী আর করার আছে আমাদের? খাবার না পেলে মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে?'

নরসিংদী সুইড বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জসিম উদ্দিন সরকার বললেন, আমার দেখা এ উচ্চশিক্ষিত দম্পতিটি তাদের দুটি সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।  তাই অসহায় এ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পরিবারটিকে বাঁচাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলসহ সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।

 

 

নরসিংদী/টিপু

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়