ঢাকা     সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ১৭ ১৪৩১

‘গণধর্ষণ’ আর ‘ফাঁড়িতে নির্যাতনে মৃত্যু’র ঘটনায় ম্লান সিলেটের সম্মান

আব্দুল্লাহ আল নোমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩২, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৯:৫৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০
‘গণধর্ষণ’ আর ‘ফাঁড়িতে নির্যাতনে মৃত্যু’র ঘটনায় ম্লান সিলেটের সম্মান

ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নিচ্ছে ২০২০ সাল। বিদায়ী এ বছরজুড়ে নানা কারণে আলোচনায় ছিল সিলেট। বছরের শুরুতেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ঝুলে থাকা তার ও বৈদ্যুতিক খুঁটিবিহীন শহর হিসেবে বিভাগীয় এ শহরের নাম উঠে আসে।

এ বছরেই সিলেটের মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা। প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে সিলেট থেকে লন্ডনে সরাসরি বিমান ফ্লাইট চালুও হয়েছে বিদায়ী এ বছরে।

তবে ২০২০ সালের শেষের দিকে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নববধূকে গণধর্ষণ আর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদের মৃত্যুর ঘটনায় ম্লান হয়েছে এ জেলার সম্মান। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের গণমাধ্যমেও এ দুই ঘটনা সমানতালে প্রকাশ পেয়েছে। আর তা মর্মাহত করেছে জনসাধারণকেও।

আরো পড়ুন:

এর বাইরে করোনায় সিলেটের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান আর গরিবের চিকিৎসক খ্যাত ডা. মঈনের মৃত্যুসহ করোনায় মারা যাওয়া স্বজন হারানোর বেদনায়ও ব্যথিত সিলেটবাসী। 

একনজরে বিদায়ী বছরে সিলেটের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলো তুলে ধরা হলো-

পুলিশ ফাঁড়িতে ‘নির্যাতনে’ মৃত্যু : ২০২০ সালে সিলেটের আলোচিত ঘটনার মধ্যে একটি হচ্ছে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে এনে টাকার জন্য যুবক রায়হানকে (৩৩) নির্যাতন করে হত্যা। ঘটনাটি ঘটে ১১ অক্টোবর ভোরে। প্রথমে পুলিশের পক্ষ থেকে রায়হানকে ছিনতাইকারি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

তবে ঘটনার পরপরই তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, টাকা না পেয়ে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে পুলিশ। আর এ ঘটনায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালী মডেল থানায় নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদি হয়ে একটি মামলাও করেন।

পরিবারের দাবির প্রেক্ষিতে প্রাথমিক তদন্তে হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ওই ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে এসআই আকবর ঘটনার পর গাঢাকা দেন।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে। তারা একে একে তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। গত ৯ নভেম্বর ভারত পালিয়ে যাওয়ার সময় সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে প্রধান অভিযুক্ত আকবরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে পালাতে সহযোগিতা করায় আরও তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এদিকে গত ২৬ নভেম্বর রায়হানের মৃত্যুর ঘটনার প্রথম ময়নাতদন্তের ভিসেরা রিপোর্ট পিবিআই’র কাছে হস্তান্তর করে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। এ রিপোর্টে অতিরিক্ত আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে গত ১৭ অক্টোবর রায়হানের প্রথম ময়নাতদন্ত রিপোর্টেও একই কথা বলা হয়েছিল। ওই রিপোর্টে রায়হানের দেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন এবং তার নখ উপড়ানো রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

গ্রেপ্তার চার জনকেই দুই দফায় রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পিবিআই। তারা বর্তমানে কারাগারে আছেন। আলোচিত এ ঘটনার আসামিদের পক্ষে সিলেটের কোন আইনজীবীই ওকালতনামা দাখিল করেননি। তাদের এমন উদ্যোগ দেশব্যাপী প্রশংসনীয়ও হয়েছে।

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নববধূকে গণধর্ষণ : গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ এলাকায় বেড়াতে যান এক নবদম্পতি। তাদের সেখান থেকে কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে যায় কয়েকজন যুবক। যারা নিজেদের ছাত্রলীগ বলে দাবি করে।
পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে নববধূকে গণধর্ষণ করে কয়েকজন যুবক। এ ঘটনার পর ছয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ নয় জনের বিরুদ্ধে নগর পুলিশের শাহপরাণ (রহ.) থানায় মামলা দায়ের করেন ওই নববধূর স্বামী।

এ ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদে ফেঁটে পড়েন সিলেটসহ দেশের সচেতন সমাজ। বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন হতে থাকে। ফলে পালিয়েও রক্ষা পায়নি আসামিরা। পৃথক অভিযানে সব আসামিকেই গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আসামিরা হলো- এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান, কলেজের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র শাহ মাহবুবুর রহমান রণি, মাহফুজুর রহমান মাসুম, অর্জুন লস্কর, বহিরাগত রবিউল ইসলাম ও তারেক। 

এর বাইরে রাজন ও তার সহযোগী আইনুলকেও অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের সবাই কারাগারে আছে। তারা দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছে।

গত ২৯ নভেম্বর ডিএনএ রিপোর্ট হাতে পান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহপরাণ থানার ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। আসামিদের ডিএনএর সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনাস্থলের ডিএনএ নমুনার মিল রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সবশেষ গত ৩ ডিসেম্বর সকালে এ আটজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

করোনায় মৃত্যুর মিছিল : ৫ এপ্রিল সিলেট জেলায় প্রথম করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন গরিবের চিকিৎসক খ্যাত ডা. মঈন উদ্দিন। ১৫ এপ্রিল ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এরপর থেকে সিলেটে বাড়তে থাকে মৃত্যুর মিছিল।

গত ৮ মাসে এ মিছিলে যোগ দিয়েছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এম এ হক, প্রবীণ সাংবাদিক আজিজ আহমদ সেলিম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহপাঠী আব্দুল হান্নান সেলিম, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের নার্স (ব্রাদার) রুহুল আমিনসহ ২৬৩ প্রাণ।

আর এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৫৩ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১৪ হাজার ৪৯০ জন। বর্তমানে সিলেটে দুটি আরটি-পিসিআর ল্যাব ও একটি অ্যান্টিজেন টেস্ট কেন্দ্রে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

বদলে যাওয়া একটি সড়ক : এসব ঘটনার মাঝেও সিলেটের কিছু প্রাপ্তিও রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো বন্দরবাজার-জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়ক সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধণ। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে এ সড়কের সৌন্দর্যবর্ধণের কাজ শুরু করে সিটি কর্পোরেশন। এরপর থেকে জনসাধারণের মাঝে এ কাজ প্রশংসা কুড়াচ্ছে।

সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘এই সড়ককে সিলেটের একটি মডেল সড়কে পরিণত করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি সড়কটি হকারমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া নতুন বছরের প্রথমদিন থেকে এ সড়কে রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি চলাচল বন্ধও করে দেওয়া হচ্ছে।’

এছাড়াও বিদায়ী বছরে টানা চার দফা বন্যায় সিলেটের নিম্নাঞ্চলের উপজেলার কৃষকের ক্ষতি, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় অর্ধ শত মৃত্যু, দুর্ঘটনার কারণে একাধিকবার সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ, বিদ্যুৎ উপ-কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের কারণে টানা বিদ্যুতহীন দুই দিন, করোনায় স্থবিরতা, করোনাকালে কিছু মানবিক মানুষের মানবিক কার্যক্রমও স্মরণীয় হয়ে থাকবে সিলেটবাসীর মনে।

সিলেট/সনি

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়