পুলিশ হেফাজতে আসামির মৃত্যু: যে কারণে সন্দেহ
জে. খান স্বপন || রাইজিংবিডি.কম
রেজাউল করিম রেজা
বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে পুলিশ হেফাজতে মৃত শিক্ষানবিশ আইনজীবী রেজাউল করিম রেজার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ডা. আতিক আহম্মেদ আকন্দ। তিনি বলেন, ধারণা করছি রেজার শরীরের একই জায়গায় বারবার নেশার ইনজেকশন পুশ করায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। সেই ক্ষত থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। এ কারণেই রেজার মৃত্যু হয়েছে।’ বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) তিনি এই তথ্য জানান।
ডা. আতিক আহম্মেদ আকন্দ বলেন, ‘১ জানুয়ারি রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে কারাগার থেকে রেজাকে এনে প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। তখন সার্জারি-১ ইউনিটের দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। রোগী রক্তশূন্যতা নিয়ে এখানে ভর্তি হন। তার বাম পায়ের সংযোগ স্থলে ক্ষতচিহ্ন ছিল। ওই ক্ষত থেকে প্রচুর রক্ত ঝরছিল। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে রক্ত দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তার হাত-পায়ের শিরাগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় ক্যানোলা পরানো যাচ্ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই কারণেই রোগীকে আমার কাছে নিয়ে আসে। তখন আমি রোগীর বাহুর নিচে ডান বুকের ওপরের শিরার সঙ্গে ক্যানোলা লাগিয়ে রক্ত ও স্যালাইন সঞ্চালনের ব্যবস্থা করি।’
‘রেজার পরিবারের অভিযোগ, তাকে পুলিশি নির্যাতনেই রেজার মৃত্যু হয়েছে।’ পরিবারে এমন অভিযোগ বিষয়ে ডা. আতিক আহম্মেদ বলেন, ‘রোগীর পুরো শরীর দেখা হয়েছে। কোথাও স্পষ্টভাবে মারধরের কিংবা দুর্ঘটনার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমনকী রোগীর কাছে জানতে চেয়েও এই ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ৪ দিন আগে কোনো মানুষকে চর-থাপ্পড় দিলেও সেই আঘাতের চিহ্ন থাকে না। বড় কোনো আঘাত হলে তার চিহ্ন ধরা পড়ে। সে ক্ষেত্রেও রেজার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে রেজার মাথায় কোনো আঘাত করা হয়েছিল কি না, ময়নাতদন্তের পরই জানা যাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. আতিক বলেন, ‘রেজা সুঁইয়ের মাধ্যমে নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করতেন বলে চিকিৎসকদের জানিয়েছিলেন। এই কারণে তার হাত-পায়ে শিরাগুলোতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক ছিল না। বেশিরভাগ সময়ই তিনি বাম পায়ের সংযোগস্থল দিয়ে নেশার ইনজেশন নিতেন। এই কারণে সেখানে ক্ষত তৈরি হয়েছে। ওই ক্ষত দিয়েই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মূলত একই জায়গায় বারবার ইনজেকশন নেওয়ায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত সার্জারির মাধ্যমে এসব ক্ষত নিরাময় সম্ভব। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে সার্জারির আগেই রেজা মারা যান।’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাত ৮টায় শিক্ষানবিশ আইনজীবী রেজাউল করিম রেজাকে বরিশাল নগরীর সাগরদী হামিদ খান সড়ক থেকে ধরে নিয়ে যান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মহিউদদ্দিন। তার দাবি, রেজার কাছে ১৩৮ গ্রাম গাঁজা ও ৪ পিস নেশাজাতীয় ইনজেকশন পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় ৩০ ডিসেম্বর কোলোয়ালী মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। এরপর ওই দিন তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয।
রেজা অসুস্থ থাকায় আদালতের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ কারা-হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়। সেখানে ১ জানুয়ারি রেজাউলের অবস্থার অবনতি হলে ওইদিন রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে তাকে কারা হাসপাতাল থেকে শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর ২ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় পুলিশি নির্যাতনে রেজার মৃত্যুর অভিযোগ এনে ৫ জানুয়ারি রেজার বাবা মো. ইউনুস মুন্সী বাদী হয়ে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিনসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে বরিশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা আমলে নিয়ে আগামী ২৩ ফেরুয়ারির মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর একজন পরিদর্শক পদ-মর্যদার কর্মকর্তাকে দিয়ে অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে, উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিনকে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে মেট্রো পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান।
বরিশাল/এনই