ঢাকা     বুধবার   ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৩ ১৪৩১

প্রতিবন্ধী হয়েও নয়ন হার মানেনি 

আমিরুল ইসলাম, রংপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ১৭ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৭:৪৪, ১৭ আগস্ট ২০২১
প্রতিবন্ধী হয়েও নয়ন হার মানেনি 

জন্মগতভাবেই শারীরিক প্রতিবন্ধী নয়ন মহন্ত। কোমড়ের হাড় বাঁকা। চলাফেরা আর ১০টা পুরুষের মতো নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবা আর বোনের করুণ অবস্থা দেখে নয়ন শেষপর্যন্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েন সংসার চালাতে।

সংসারের ঘানি টানতে বেছে নেন একটি রিকশা। এভাবে ১৫ বছর ধরে প্রতিবন্ধী হয়েও রিকশা চালিয়ে পরিবারের ভার বইছেন নয়ন। নিজের বসতভিটা নেই নয়নের বাবার। অন্যের পরিত্যক্ত জমিতে ঘর তুলে পরিবার নিয়ে থাকছেন তিনি।

মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) সকালে রংপু্র নগরীর তাজহাট মোড়ে রিকশা চালানো অবস্থায় দেখা হয় নয়নের সঙ্গে।

প্রতিবন্ধী হয়েও রিকশা চালানোর বিষয়ে নয়ন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘গরিবের যন্ত্রণা বেশি, দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। আমাদের কপাল খারাপ। আমি প্রতিবন্ধী। বাবার বয়স ৭০ বছরের কাছাকাছি। পরিবারে কেউ নেই রোজগার করার মতো। প্যারালাইসিস রোগে অসুস্থ বাবার ওষুধ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মাসহ অন্যদের দেখাশুনা সবই আমাকে করতে হয়। কেউ আমাকে কাজ দেবে না। এ জন্য আমি প্রতিবন্ধী হয়েও রিকশা হাতে নিয়েছি গত এক যুগের বেশি সময় ধরে।'

নয়ন বলেন, 'আমার বুদ্ধিসুদ্ধি কম ছোটকাল থেকে। দেখে এসেছি বাবা অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকছেন। এই ১৫-১৬ বছরে ৫-৬ বার ঘরটি একেক জায়গায় স্থানান্তর করতে হয়েছে। এলাকার বড় লোকদের পরিত্যক্ত জায়গা পরিষ্কার করে টিনের চালা তুলে থাকছি আমরা। ৩-৪ বছর না যেতেই ঘর ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র যেতে হয়েছে।’

শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় নয়নের রিকশায় অনেকে উঠতে চান না। তার উপর তার প্যাডেলের রিকশা চলে ধীরগতিতে। নয়ন বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করছি একটা চার্জার রিকশা কিনতে। কিন্তু বাবার চিকিৎসা খরচ, আর ৩-৪ বছর পরপর ঘরটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে ব্যয় হয় অনেক। তাই চার্জার রিকশা কিনতে পারিনি।’ 

রংপুর নগরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের তাজহাট মোল্লা পাড়ায় থাকেন নয়ন মহন্ত। রিকশা চালানোর টাকায় বাবার ওষুধ, বোন আর ভাগ্নির পড়ালেখার জোগান দিয়ে আসছেন নয়ন। একদিন রিকশা না চালালে সবাইকে উপোস থাকতে হয়। গত সপ্তাহে ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলেছে জমির মালিক। এই বর্ষার মৌসুমে অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছেন না। 

৩৩ বছর বয়সী নয়ন লেখাপড়া করতে পারেননি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর অভাব অনটনের সংসার তাকে দমিয়ে রেখেছেন। তবে তিনি কারও বোঝা হননি। বরং নিজে মা-বাবা আর বোনদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এভাবে উপার্জন করে ৯ বছর আগে বোনকে বিয়ে দেন। কিন্তু ভাগ্য খাবাপ্। এখন বোন আর ভাগ্নি তার সংসারে চেপে বসেছে। তাদেরও ভরণপোষণ দিতে হয় নয়নকে।

নয়নের অসুস্থ বাবা জগদ্বীশ চন্দ্র মহন্ত বলেন, ‘আগে আমি পরিশ্রম করে সংসার চালাতাম। এখন চলতে পারি না। গত ৭ বছর হলো অসুস্থ হয়ে পড়ে আসি। নয়ন সংসারের হাল ধরেছে।’  

নয়নের মা মালতী রানী বলেন, ‘অন্যের জমিতে থাকা কষ্টকর। কয়েক দফায় ঘর ভেঙে নিয়ে ঘর বানাতে হয়েছে। নয়নের রোজগারে এক যুগ ধরে সংসার চলে। নয়ন আয় করতে না পারলে পরিবারের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে এসে নয়ন যখন বলে- পা ব্যথা করছে। তখন কান্নায় বুক ফেটে যায়।’ 

ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম বাবলা রাইজিংবিডিকে জানান, নয়নের পরিবারে উপার্জন করার কেউ নেই। প্রতিবন্ধীভাতার পাশাপাশি তাদের সহযোগিতা দেওয়া হয়।  নয়নের বাবার বয়স্ক ভাতার জন্য কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, অচিরে তার ভাতা চালু হবে। 

আমিরুল/বকুল 


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়