দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে মিলছে না ইলিশ
ইমরান হোসেন, বরগুনা || রাইজিংবিডি.কম
ভরা মৌসুমেও দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত রুপালি ইলিশ। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে গিয়ে খালি হাতে ফিরছেন জেলেরা। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পরিচালক বলছেন, গত চার বছর ধরে মাত্রাতিরিক্ত হারে ইলিশের পরিমাণ কমে নেমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশে। আড়ৎদার-পাইকাররাও বলছেন, সাগরে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বেহালদশা মৎস্য ব্যবসায়ীদের।
ইলিশসম্পদ রক্ষা করতে বরগুনার তিনটি নদী ও মোহনা ইলিশের অভায়াশ্রম ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
বরগুনার পাথরঘাটার দেশের ২য় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র কয়েক বছর আগেও ছিলো ইলিশে সয়লাব। পাইকার-আড়ৎদার আসতো বিভিন্ন জেলা থেকে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মৎস্য ব্যবসায়ীদের কেনাবেচায় মুখরিত এ মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে পা ফেলার জায়গাও থাকতো না।
চার বছরের ব্যবধানে পাল্টে গেছে এ মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের চিত্র। এখন আর ট্রলারভর্তি ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরছেন না জেলেরা। কিছু কিছু জেলে কিছু সংখ্যক ইলিশ নিয়ে আসলেও বেশিরভাগ ট্রলারই থাকে ইলিশশূণ্য।
এফ বি মায়ের দোয়া ট্রলারের মাঝি ছালেহীন সফিক রাইজিংবিডিকে বলেন, ২৪ জুলাই নিষেধাজ্ঞা শেষে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকারে যান তিনিসহ মায়ের দোয়া ট্রলারের ১৮ জেলে। টানা ১৩ দিন সাগরের বিভিন্ন স্থানে ছয় বার জাল ফেলেও দেখা মেলেনি ইলিশের। ৫ আগস্ট আবার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে ফিরে দেড় লাখ টাকার কেনাকাটা করে ৭ আগস্ট আবারও সাগরে যান তারা। সেই থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ইলিশের জাল ফেলেও দেখা মেলেনি ইলিশের। দুই বার সাগর যাত্রায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে মাছ বিক্রি করেছেন ৭৮ হাজার টাকা।
নোয়াখালীর এফ বি সজীব ট্রলারের মাঝি জীবেন্দ্রনাথ আশ্চার্য রাইজিংবিডিকে বলেন, ৫ বছর আগেও প্রচুর ইলিশ ধরা পরতো দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে। তবে গত ৪ বছর ধরে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
বরগুনা সদরের এফ বি মুক্তা ট্রলারের মাঝি জসিম রাইজিংবিডিকে বলেন, সাগরে ইলিশের পরিমাণ খুবই কম। ১০/১২ বার বিভিন্ন স্থানে জাল ফেলে ১ মণ থেকে সর্বোচ্চ ২ মণ ইলিশ পাওয়া যায়। যাতে তাদের লোকসান হয় প্রচুর।
ভরা মৌসুমে খালি হাতে একটি করে ট্রলার আসছে আর হতাশায় মাথায় হাত পরছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়ৎদার ও পাইকারদের। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়ৎদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, আড়ৎদাররা বিভিন্ন ট্রলারের মাঝিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছেন ইলিশ কেনার জন্য। তবে বেশিরভাগ জেলে ফিরছেন ইলিশশূণ্য ট্রলার নিয়ে।
পাইকার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নিউ আল-আমিন ফিসের মালিক মোহাম্মাদ আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, গত বছর বেশি দামে ইলিশ কিনে লোকসানে পড়েছেন তারা। এবারও একই অবস্থা। যে অল্প পরিমাণে ইলিশ আসে ঘাটে, তা দুই-তিন জন পাইকার কিনে নিয়ে যান। স্থানীয় বাজারের চাহিদাও মিটাতে পারছেন তারা।
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধূরী রাইজিংবিডিকে বলেন, সরকারি গবেষণায় ইলিশ সম্পদের বৃদ্ধি দেখালেও বাস্তবে ইলিশশূণ্য দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর। প্রতিটি ট্রলারে ১৮ থেকে ২০ জন জেলে থাকে। একবার সাগরে যেতে অন্তত দেড় থেকে দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়। সেই টাকাও উঠছে না। একটু লাভের আশায় বার বার সাগরে যাচ্ছেন জেলেরা। প্রতিবারই লোকসান হয়। ট্রলার মালিকরা এখন জেলেদের বেতনও দিতে পারছেন না।
মৎস্য অবতরন কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ৩ হাজার ৭৭৫ মেট্রিক টন ইলিশ উঠেছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ৭০০ মেট্রিক টন কমে গিয়ে ইলিশ ওঠে ৩ হাজার ২১ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ১০০ মেট্রিক টন কমে গিয়ে ইলিশ ওঠে ২ হাজার ৯১১ মেট্রিক টন। আর ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ১ হাজার ৭৫৯ মেট্রিক টন কমে গিয়ে ইলিশ উঠেছে ১ হাজার ১৫২ মেট্রিক টন।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পরিচালক লেফটেন্যান্ট এম লুৎফর রহমান (বিএন) রাইজিংবিডিকে বলেন, প্রতি ১০০ টাকার ইলিশ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বিক্রি হলে সরকার রাজস্ব পায় ১ টাকা। তবে মাত্রাতিরিক্ত হারে কমে গেছে ইলিশের পরিমাণ। কমে গেছে সরকারের রাজস্ব।
সম্প্রতি বরগুনার তিনটি নদী পায়রা, বলেশ্বর, বিষখালী ও সাগর মোহনায় গবেষণা শেষ করেছে ওয়াল্ড ফিশের দল। গবেষণা শেষে মীর মোহাম্মাদ আলী রাইজিংবিডিকে বলেন, তিন নদী ও মোহনায় ডিম পাড়তে আসে মা ইলিশ। সেই সময় সেই ইলিশ আটকা পড়ে নদী মোহনার অবৈধ সূক্ষ ফাঁসের জালে।
অন্যদিকে, বেশিরভাগ পোনা ইলিশ সাগর থেকে মিঠা পানি ও মাটি খেয়ে বড় হতে চলে আসে তিন নদী ও মোহনায়। তবে সেসব পোনা মাছও আটকা পড়ে এসব জালে। তাই বছরের পর বছর কমে আসছে ইলিশের পরিমাণ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে ইলিশ পাওয়া যাবে না।
এই গবেষক দাবি করেন, পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা না করলে বিলুপ্ত হবে ইলিশ।
এদিকে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব রাইজিংবিডিকে বলেন, পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদীকে অভায়াশ্রম ঘোষণা করার জন্য ইতিমধ্যে প্রাথমিকভাবে মৎস্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে, শীঘ্রই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন ঊধ্র্বতন কর্মকর্তারা।
বেসরকারি হিসেবে বরগুনা উপকূলের প্রায় দেড় লাখ মানুষ মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত। তাদের মধ্যে শুধু ইলিশ মাছ শিকার করে ৮০ হাজার জেলে।
/বকুল/