স্মৃতিসৌধ নির্মাণে মর্তুজ আলীর নিজের ভিটে দান
বড়ইতলা রেলক্রসিংয়ের পাশে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ও শহীদদের নাম ফলক, ইনসেটে মো. মর্তুজ আলী মস্তুফা
দেশে হঠাৎই পাকবাহিনীর আক্রমণ। নিরহ বাঙালী জাতির ওপর শুরু হয় নির্মম অত্যাচার। চারিদিকে গোলাগুলি, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট আর হত্যাযজ্ঞ এখনও তার চোখে জলজল করে ভেসে উঠে। কথাগুলো দেশপ্রেমিক মো. মর্তুজ আলী মস্তুফা বলছিলেন আবেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে। সেদিনের সে ভয়াল স্মৃতিগুলো আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোনোভাবেই সে স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেন না। আর হয়তো ভুলতেও চান না। তাইতো মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণে দান করেছেন নিজের ১৭ শতক ভিটে।
১৯৭১ সালে তখন তার বয়স মাত্র ১১ বছর। কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের যশোদল ইউনিয়নের স্থানীয় সিরাজুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র তিনি। বেশ ভালই চলছিল তার জীবন। কিন্তু ভাল সময়টা বেশিদিন ভাল থাকেনি। হঠাৎ দেশে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতা আন্দোলনের লড়াই। লেখাপড়া বন্ধ, দিন কাটে আতঙ্কে।খুব কাছ থেকে দেখেছেন প্রিয় মানুষদের ওপর পাকবাহিনীর নিমর্ম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ।
১৩ অক্টোবর সকালে পাকবাহিনীরা একটি মালবাহী ট্রেনে করে বড়ইতলা গ্রামের কাছে পৌঁছায়। এসময় স্থানীয় রাজকাররা পাকবাহিনীর সদস্যকে হত্যা করার গুজব ছড়িয়ে দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকসেনারা হিংস্র পশুর মতো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে ৩৬৫ নিরীহ মানুষকে। জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিয়েছিল বড়ইতলা, চিকনিরচর ও দামপাড়াসহ কয়েক গ্রাম। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ছলচল করছিল মর্তুজ আলীর।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সনে তার বাবা আব্দুর রহিম শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে বড়ইতলা রেলক্রসিংয়ের পাশে ২ শতক জায়গা লিখে দেন, প্রশাসনের নিকট। পরে তৎকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্মৃতিসৌধ নির্মাণে সেখানে একটি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯৩ সনে মর্তুজ আলীর বাবা মারা যান। পরে ১৯৯৬ সনে শহীদদের স্মৃতি পাঠাগার, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে তিনি আরও ১৫ শতক জায়গা প্রশাসনের নিকট হস্তান্তর করেন।
পরবর্তীতে অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ১৭ শতক জায়গার ওপর স্মৃতিসৌধ, শহীদদের নাম ফলক নির্মিত হয়েছে। তবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করার পর, এখন পর্যন্ত কোথাও ওনার নাম না থাকায় আক্ষেপ রয়ে গেছে মর্তুজ আলীর।
তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার বাবা ও আমি শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে জায়গাটি দান করেছিলাম। আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। আমি সবচেয়ে আনন্দিত ও গর্বিত আমার জায়গাটির ওপর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, সেই সব শহীদদের নামের তালিকা রয়েছে এবং একটি স্মৃতি সৌধও নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি সেটিই আমার ভাললাগা। আমি না থাকলেও আমার নামটি মানুষের মুখে মুখে থাকবে।’
স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত আছেন তার স্ত্রী মোছা. নূরুন্নাহার। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমাদের সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। আমরা সবাই ওনাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। যখন বিভিন্ন পত্রিকায় ঊনার নাম এবং টিভিতে ওনাকে দেখি, আমাদের অনেক গর্ব হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প আমাদের কাছে বলেছেন। খুব কাছ থেকে ঊনি ওই সময়ে গ্রামের মানুষের ওপর নির্মমতা ও বর্বরতা দেখেছেন। তাই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ওনার এমন ভালবাসা, দেশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
মর্তুজ আলী আরও বলেন, ‘সেদিনের বিভিষিকাময় দিনের কথা মনে হলে আজও শিউরে উঠি। মানুষ-মানুষের ওপর কিভাবে এমন অত্যাচার করে, সেটি নিজ চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। সরকারের নিকট নিহতদের শহীদের মর্যাদা, স্থানীয় রাজাকারদের বিচার, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস ধরে রাখতে এখানে একটি স্মৃতি পাঠাগার গড়ে তোলার জোড় দাবি জানাচ্ছি।’
রুমন/বুলাকী