রাতের আঁধারে পাকসেনারা মাগুরা ছেড়ে পালায়
মাগুরা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
মাগুরা মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাগুরা পাক হানাদার মুক্ত হয়। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মাগুরা জেলার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মিত্র বাহিনীর ভয়ে রাতের আঁধারে পাকসেনারা মাগুরা ছেড়ে পালায়।
একাত্তরের ২ মার্চ শহরের চৌরঙ্গীর মোড়ে তৎকালীন কোর্ট চত্বরের সামনে বটতলায় মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউর ইসলাম বিপ্লবী বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্য মাগুরার মানুষের মাঝে ব্যাপক অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। এ সময় তাৎক্ষণিকভাবে মুন্সি রেজাউল হককে মাগুরা মহাকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি করে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পরবর্তীতে এ দুটি পরিষদ গঠনের পর থেকে তারা ঢাকার ঘোষনা অনুযায়ী মাগুরাতেও ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে।
৩ মার্চ মাগুরায় সফল হরতাল পালন করে। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আসাদুজ্জামান অন্যতম দু উপদেষ্টা সৈয়দ আতর আলী ও অ্যাড. সোহরাব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যহত রাখে।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার পর পাকবাহিনী সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলেও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২৬মার্চ মাগুরার প্রবেশপথগুলোতে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে এক কঠিন প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তোলে।
২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গা ইপিআর এর ৪নং উইং কমান্ডার মেজর ওসমান বিদ্রোহ ঘোষণা করে এক প্লাটুন সদস্য ও অস্ত্রসহ মাগুরার সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগ দিতে আসেন।
যা পরবর্তীতে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করে নোমানী ময়দান, পারনান্দুয়ালী শেখপাড়া আমবাগান, ওয়াপদা, সদর উপজেলার কাটাখালি ব্রিজসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়।
৪ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহম্মেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম মাগুরা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হন।
ওই দিনই মাগুরা যশোর সড়কের লেবুতলায় পাক বাহিনীর সঙ্গে সুবেদার আব্দুল মুকিতের নেতৃত্বে মাগুরা সংগ্রাম পরিষদের ব্যাপক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যা ৭ এপ্রিল পর্যন্ত দফায় দফায় চলতে থাকে। এ যুদ্ধে ১৫ জন নিহত হন।
মাগুরা সংগ্রাম পরিষদ বিশাল প্রতিরোধ ব্যবস্থা অব্যহত রাখলেও ২২ এপ্রিল সোমবার দুপুরে পাকবাহিনী বিশাল ট্যাংক বহর নিয়ে ঝিনাইদহ-যশোর শহর দিয়ে মাগুরা সীমানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এদিন মাগুরার আলমখালী বাজার এলাকায় সুরেন বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিকে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে।
পরদিন ২৩ এপ্রিল জয়বাংলা শ্লোগান দেওয়ায় পাক বাহিনী বাগবাড়িয়া গ্রামের লালু নামে এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে হানাদাররা শহরের পিটিআই, ভিটিআই, সিও অফিস (বর্তমান উপজেলা পরিষদ চত্বর), মাগুরা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, নিউ কোর্ট বিল্ডিং, মাইক্রো ওয়েভ স্টেশন ও মাগুরা সরকারি কলেজে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। শহরের মধুমতি ডাকবাংলোটিকে তারা হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে তাদের যোগসাজশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞসহ বর্বর হামলা ও নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে।
মাগুরা শ্রীপুরের আকবর বাহিনী, মহম্মদপুরের ইয়াকুব বাহিনী, মহম্মদপুর ফরিদপুর অঞ্চলের মাশরুরুল হক সিদ্দিকী কমল বাহিনী, মাগুরা শহরের খন্দকার মাজেদ বাহিনী এবং মুজিব বাহিনী বিশেষ সাহসী ভূমিকা নিয়ে পাক সেনা ও স্থানীয় রাজাকার আল বদর বাহিনীর সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধ করে।
কমল বাহিনীর প্রধান মাশরুরুল হক সিদ্দিকী কোমল ভাটিয়াপাড়ায় সম্মুখ যুদ্ধে গুলিতে তার একটি চোখ হারান। শ্রীপুর বাহিনীর রনাঙ্গণে একের পর এক বিরোচিত অভিযান পাক হানাদার বাহিনীকে তটস্থ করে তোলে। শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ বাহিনী মূলত মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর এলাকাজুড়ে তৎপরতা চালায়।
এ বাহিনীর অব্যহত অভিযান ও স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর তৎপরতায় পাক বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। এ দু বাহিনী ৬ ডিসেম্বর মাগুরাকে হানাদার মুক্ত করতে নিজনান্দুয়ালী গ্রামে ও বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়।
মিত্রবাহিনীর ভয়ে পাকিস্তানি সেনারা রাতারাতি মাগুরা শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরদিন ৭ডিসেম্বর মাগুরা শত্রুমুক্ত হয়। হানাদার মুক্ত হওয়ার আনন্দে মুক্তিকামি মানুষের ঢল নামে সারা শহরে। জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে মাগুরার আকাশ বাতাস।
৭ ডিসেম্বর মাগুরা মুক্ত দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালন উপলক্ষ্যে মাগুরা জেলা মুক্তিযোদা সংসদ, জেলার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সকালে শহীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শহরের নোমানী ময়দানে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্থম্ভে পুস্পস্তবক অর্পণ, বর্ণ্যাঢ্য র্যালি, লাঠি খেলা ও সাপখেলা। আছাদুজ্জামান মিলনায়তনে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও আমন্ত্রিত মুক্তিযোদ্ধাদের আপ্যায়ন।
শাহীন/মাগুরা//টিপু