‘যুদ্ধ করতে এসেছি পেছনে ফিরে যাবো না’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
১৯৭১। ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল আদিনা কলেজ মাঠে। একদিন সকালে ক্যাম্পের কামান্ডার শাজাহানের কাছে সংবাদ এলো- শত্রুপক্ষ ৩ দিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। তখন কমান্ডার নির্দেশ দিলেন, দ্রুত পজিশন নেয়ার। আমরা চারজন ছিলাম। তার মধ্যে একজন তরুণ ছিল আনিসুর রহমান। তার হাতে ছিল রাইফেল। সেদিন বৃষ্টির মতো আমাদের লক্ষ্য করে পাকসেনারা গুলি করছিল। আমি আনিসুরকে বললাম, তুমি সামলাতে পারবে না। নিরাপদ স্থানে সরে যাও। সে তখন বলল- আমি যোদ্ধা। যুদ্ধ করতে এসেছি, পেছনে ফিরে যাব না। বলতে না বলতেই একটি গুলি এসে লাগে তার শরীরে। আনিসুর সেখানেই লুটিয়ে পড়ে মারা যায়।
রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদককে বিষণ্ন কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল ইসলাম। সেদিন যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছিলেন। সফিকুল আলম স্মৃতিচারণ করে বলেন, এর মধ্যে আমার বন্ধু শামসুল ইসলামও ছিল। আমরা একসঙ্গে প্রথমবারের মতো রায়গঞ্জে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সেদিনও আমরা একসঙ্গে রণাঙ্গনে ছিলাম। হঠাৎ আমার গায়ে রক্ত ছিটে আসায় তাকিয়ে দেখি শামসুলের গায়ে গুলি লেগেছে। দ্রুত কাপড় দিয়ে তার ক্ষতস্থান বেঁধে দিলাম।
কমান্ডার নির্দেশ দিলেন আপাতত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু শামসুলকে রেখে যেতে মন চাইছিল না। তখন সেই আমাকে বলল- তোমরা যাও, যুদ্ধ করো। দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। তখন তাঁকে রেখেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করি। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
পরে আমরা বিনোদপুরের আজমতপুর ক্যাম্পে আশ্রয় নেই। সেখানে আমাদের সঙ্গে দেখা হলো ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। আমি এর মধ্যে বাড়ি যেতে চাইলে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর বললেন, আমরা এখনও দেশ স্বাধীন করতে পারিনি। আপনি বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে আবার যোগ দেবেন। আমি তাঁর কথা মতো বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। আমাকে দেখে মা খুব কাঁদছিল। নিজ হাতে খাবার এনে দিলেন। কিন্তু দেরি হয়ে যাবে বলে মায়ের দেয়া খাবার সেদিন খেতে পারিনি। মাকে রেখেই ফিরলাম রণাঙ্গনে।
১৪ ডিসেম্বর ভোরে নবাবগঞ্জ শহর মুক্ত করার জন্য অভিযান চালানো হয়। তুমুল যুদ্ধ হলো সেদিন। আমরা চাইছিলাম সেদিনই নবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত করতে। এই যুদ্ধেই মৃত্যুবরণ করেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। সেদিন আমরা সবাই বিষণ্ন মন নিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে গেছি।
মেহেদী হাসান/তারা