রস-গুড় ঘিরে সেই উৎসব নেই, তবুও…
জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম
একটা সময় ছিল শীত আসলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খেঁজুরের রস, গুড় নিয়ে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে যেতো। অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে রসের জন্য খেঁজুর গাছ প্রস্তুত করা, কুমারের বাড়ি থেকে ভাড় (রস রাখার ছোট কলস) এনে আগুনে তাপ দিয়ে রস রাখার উপযোগী করা, রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানোর জন্য জ্বালানি (লাকড়ি) জোগাড় করে রাখা, দা শান দেওয়া, দড়ি পাকানো— ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন কৃষকরা।
তখন বাড়ির কৃষাণীরও দিনের অর্ধেক সময় ব্যস্ত থাকতে হতো রস জ্বালিয়ে গুড় বা পাঠালি বানানোর কাজে। বাড়ির ছোটরাও রস-গুড় থেকে দূরে থাকতে পারতো না। এ কাজে বাবা-মাকে সহায়তা করা, বাড়ির কুকুর-বিড়াল থেকে রস-গুড় পাহারা দিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করতে হতো তাদের। তবে শিশুদের বড় আনন্দ ছিল সকালে মাঠ থেকে রস আনার পর মগভরে তা খাওয়া। এই খাওয়ার পর্ব চলতো দলবেঁধে।
দুই-তিন দশক আগের রস-গুড় নিয়ে সেই আনন্দ আয়োজন এখন আর চোখে পড়ে না। এখনকার শিশুরা জানেই না রস-গুড় নিয়ে উৎসবের কথা।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরায় ব্যাপক সংখ্যায় খেঁজুর গাছ ছিল। শীত মৌসুমে স্থানীয় হাটে-বাজারে গুড় বিক্রির জন্য স্থান নির্ধারিত ছিল। সেখানে সপ্তাহে এক বা দুই দিন কৃষকরা তাদের কয়েকদিনের উৎপাদিত গুড় নিয়ে যেতো বিক্রির জন। দূর-দূরান্তের জেলা থেকে পাইকাররা সেই গুড় কিনতে আসতো। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে এক ভাড় (৫/৬ কেজি পরিমাণ গুড়) ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হতো। বছরের কয়েক মাস কৃষকের আয়ের উৎস ছিল গুড়। এলাকার প্রত্যেক কৃষক পরিবারে রস-গুড় ছিল। তারা সারা বছরের জন্য গুড় রেখে দিয়ে বাড়তিটা বিক্রি করে দিতো।
দেশের উত্তর বা মধ্যাঞ্চলে খেঁজুর গাছ থাকলেও তা অধিক সংখ্যায় ছিল না। রস-গুড়ের ব্যবসা ছিল মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কামারালি গ্রামের বৃদ্ধ অজিয়ার রহমান বলেন, এ গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে রস-গুড় ছিল। গ্রামের কয়েকজন গৃহস্থের বাড়িতে প্রায় প্রতিদিন অর্ধশতাধিক ভাড় রস হতো। বিকেল পর্যন্ত সেই রস জ্বালিয়ে ১০/১২ ভাড় গুড় পাওয়া যেতো। সকালের রস জ্বালিয়ে উঠতে না উঠতে সন্ধ্যায় মাঠ থেকে রস চলে আসতো। যদিও সন্ধ্যায় আসতো মাত্র কয়েক ভাড় রস। এবং সেটি ঘোলা রস।
ওই গ্রামের গাছী মো. ছালাম খেঁজুর গাছ কাটা এবং রস সংগ্রহ বিষয়ে বলেন, সাধারণত বিকেলে খেঁজুর গাছ কাটা হয়। সেই রস পরের দিন ভোরে সংগ্রহ করা হয়। সেটি পরিষ্কার বা জিরিন রস। এই রসের গুড় মিষ্টি। এই গুড় দিয়ে পাঠালি বানানো যায়। ওই গাছ থেকে পরের দিন যে রস পাওয়া যায়, সেটি ঘোলা বা ওলা রস। দ্বিতীয়দিনের রস যাতে বেশি টক না হয়ে যায়, সেই জন্য সন্ধ্যায় গাছের ভাড় থেকে রস নামিয়ে সেটি ফাঁকা করে দেওয়া হয়। এই ঘোলা রসের গুড় দিয়ে পাঠালি বানানো যায় না, কেননা এই গুড় টক স্বাদযুক্ত হয়।
তিনি জানান, শীত যত তীব্র হয়, গাছে রসের পরিমাণ তত বেশি হয় এবং দ্বিতীয় দিনের রস টক কম হয়।
তবে এখন মাত্র গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে রস পাওয়া যায় বলে জানান ছালাম। তিনি জানান, এখন আর কৃষক খেঁজুর গাছ কাটতে আগ্রহী হয় না। মাঠের বেশিভাগ গাছ পড়ে থাকে। গ্রামের কয়েকজন গাছী অন্যের খেঁজুর গাছ বর্গা নিয়ে রস উৎপাদন করে। রস-গুড় ঘিরে গ্রামের সেই উৎসবের আমেজ এখন নেই। রস বা রসের পিঠা খাওয়ার জন্য ওই গাছীদের বাড়ি ভিড় করে গৃহস্থরা। গাছীও চড়া দামে রস বিক্রি করে।
চলতি বছর যশোর জেলার ১৬ লাখ খেঁজুর গাছের মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩ লাখ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র সরকার। তিনি জানান, পেশার পরিবর্তন ও কৃষি জমি কমে যাওয়ার কারণে রস উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
মাগুরার সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখা উপজেলা খেঁজুর রস, গুড়, পাটালির জন্য প্রসিদ্ধ হলেও মাত্র কয়েক হাজার গাছী এ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়ীয়া গ্রামের হাফিজুর রহমান বলেন, এখন চলছে রস সংগ্রহের ভরা মৌসুম। ১০টি খেঁজুর গাছ থেকে ৪০- ৫০ লিটার রস সংগ্রহ করা যায়; যা দিয়ে ৬-৮ কেজি গুড় বা পাটালি হয়। প্রতি কেজি গুড়ের দাম এখন ৩০০ টাকা।
স্থানীয়রা জানান, একসময় মাগুরায় প্রচুর খেঁজুর গাছে চোখে পড়তো। পতিত জমি কমে যাওয়া, ইটের ভাটায় জ্বালানি হিসেবে খেঁজুর গাছ পোড়ানো, অতিরিক্ত পরিশ্রম হওয়ায় কৃষকের গুড় উৎপাদনের অনীহার কারণে খেঁজুর গাছ কমে গেছে। নতুন করে খেঁজুর বাগান গড়ে উঠছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, জেলায় সাড়ে ৪ লাখ খেঁজুরগাছ রয়েছে। গাছী না থাকায় অধিকাংশ গাছ থেকে রস সংগ্রহ হয় না। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আব্দুস সোবাহান জানান, সম্প্রতি খেঁজুরের রস-গুড়ের চাহিদা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের আবার রস সংগ্রহে আগ্রহ বেড়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. নূরুল ইসলাম জানান, সাতক্ষীরার সাত উপজেলার ৭৮ ইউনিয়নে ২০১৯-২০ অর্থবছরে খেঁজুর গাছ ছিল ৮২ হাজার ৭৯০টি। গুড় উৎপাদন হয় ১৩০ মেট্রিক টন। আর চলতি বছরে খেঁজুর গাছের সংখ্যা ৭৯ হাজার ৪৮০টি। এ বছর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০ মেট্রিক টন।
কৃষিবিদ মো. নূরুল ইসলাম জানান, রস-গুড়ের সুদিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে জেলা ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৭৮টি ইউনিয়নের গ্রামাঞ্চলে রাস্তার পাশে খেঁজুর গাছের চারা রোপণ করা হবে।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র সরকার জানান, সরকারিভাবে খেঁজুরের রস উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এবং খেঁজুরের গাছ রক্ষার জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে যশোরের নিজস্ব প্রতিবেদক সাকিরুল কবীর রিটন, মাগুরার জেলা প্রতিনিধি শাহীন আনোয়ার, সাতক্ষীরার জেলা প্রতিনিধি শাহীন গোলদার সহায়তা করেছেন।)
/বকুল/