ঢাকা     শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১৩ ১৪৩১

পদ্মা সেতুতে বাড়তি টোলের অজুহাতে বাড়ছে পরিবহন ভাড়া

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৩১ মে ২০২২  
পদ্মা সেতুতে বাড়তি টোলের অজুহাতে বাড়ছে পরিবহন ভাড়া

মাওয়া রুটে চলাচলকারী কয়েকটি পরিবহনের কাউন্টার

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ এ সেতু। ওই দিন থেকেই সেতুর ওপর দিয়ে চলবে সব ধরনের যানবাহন।

এদিকে, পদ্মা সেতুর টোল বেশি হারে নির্ধারণ করা হয়েছে, এ অভিযোগ তুলে যানবাহনের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা। যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে এ বিষয়ে মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে বলে সূত্র জানিয়েছে। জনপ্রতি বাস ভাড়া ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অপরদিকে, পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা। তারা বলছেন, নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, তাহলে তো টোল নেওয়ার প্রয়োজন নেই। টোল নেওয়া হলেও তার পরিমাণ কম হওয়া উচিত ছিল। এখন টোল বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হলে সাধারণ যাত্রীদের ওপর চাপ পড়বে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা থেকে পদ্মা সেতু অর্থাৎ মাওয়া রুটে ৫-৬টি কোম্পানির দুই শতাধিক বাস চলাচল করে। এছাড়াও আছে মাইক্রোবাসসহ একাধিক প্রাইভেট সার্ভিস। 

পরিবহন কোম্পানিগুলোর মধ্যে ফাল্গুনী পরিবহন প্রাইভেট লিমিটেড, টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, গ্রীণলাইন পরিবহন, বনফুল পরিবহন, সুন্দরবন ক্লাসিক প্রাইভেট লিমিটেড ও এমাদ পরিবহন উল্লেখযোগ্য।

এসব কোম্পানির বাসে বর্তমানে সর্বনিম্ন ভাড়া নন- এসি বাসে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং এসি বাসে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এখন পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহনভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৩ হাজার ৯৫০ টাকা। পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে টোল দিতে হবে ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকা।

খুলনা-ঢাকা রুটে চলাচলকারী যাত্রী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি বেসরকারি চাকরিজীবী। সবকিছুর দাম বাড়লেও আমাদের বেতন কিন্তু বাড়ছে না। ফলে, বাসভাড়া বাড়ানো হলে আমাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে।’

আরেক যাত্রী শাকিল আহমেদ শান্ত বলেন, ‘যে ভাড়া আছে, সেটিই থাকা উচিত। কোনোভাবেই পরিবহন ভাড়া বাড়ানো ঠিক হবে না।’

শিপিং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. ইমরান মল্লিক বলেন, ‘যেহেতু নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, সেহেতু টোল নেওয়ার দরকার নেই। টোল না নিলে তো আর বাসভাড়া বাড়বে না। আর নিলেও টোলের পরিমাণ কম হওয়া উচিত।’

সিনিয়র সাংবাদিক কাজী মোতাহার রহমান বলেন, ‘জনগণের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পর মাত্রাতিরিক্ত টোল আদায় কোনোমতেই দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে পদ্মা সেতুতে বাড়তি টোলের কারণে পরিবহনে ব্যয় বাড়াবে। এ ব্যয়ভার বহন করা কঠিন। উচ্চ মাত্রার টোলের খেসারত দিতে হবে মানুষকে। পদ্মা সেতুর অতিরিক্ত টোল জাতির কাঁধে বড় বোঝা।’

বনফুল পরিবহনের খুলনা রয়েল কাউন্টারের ম্যানেজার আব্দুল জলিল খলিফা জানিয়েছেন, তাদের ১২টি নন-এসি বাস মাওয়া রুটে চলাচল করে। ভাড়া ৫০০ টাকা করে। এখন পদ্মা নদীতে ফেরি পারাপারে ১ হাজার ৮০০ টাকা দিতে হয়, সেখানে সেতুতে গুনতে হবে ২ হাজার ৪০০ টাকা। সেতু দিয়ে পারাপারে সড়কপথের দূরত্বও ৭-৮ কিলোমিটার বাড়বে। এতে পরিবহনের খরচও বেড়ে যাবে। এ কারণে ভাড়াও বাড়বে। তবে, এ বিষয়ে মালিকপক্ষ এখনও সিদ্ধান্ত নেননি।

টুঙ্গিপাড়া  এক্সপ্রেসের কাউন্টারম্যান মো. কামরুল ইসলাম স্বপন জানান, বর্তমানে তারা নন-এসি বাসে ৬০০ এবং এসি বাসে ৭০০ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন। সেতু চালু হলে ভাড়া বাড়বে। তবে, কত টাকা বাড়ানো হবে, সে বিষয়ে মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।

ফাল্গুনী পরিবহন প্রাইভেট লিমিটেডের কাউন্টারম্যান মো. মুজিবুর রহমান জানান, তাদের বাসে এসি বিজনেস ক্লাস ৯০০ টাকা, এসি ইকোনোমি ক্লাস ৭৫০ টাকা এবং নন-এসি চেয়ার কোচের ভাড়া ৬০০ টাকা করে। পদ্মা সেতু চালু হলে টোলসহ অন্যান্য খরচও বেড়ে যাবে। ফলে, ভাড়াও কিছুটা বাড়াতে হবে।

গ্রীণ লাইন পরিবহনের খুলনার সাত রাস্তা কাউন্টারের ম্যানেজার এম এ খায়ের বলেন, বর্তমানে তারা ১ হাজার টাকা করে ভাড়া নিচ্ছেন। সেতু চালুর পর ভাড়া বাড়তে পারে।

একইভাবে ঈগল পরিবহনের খুলনার সিনিয়র কাউন্টার ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল বারিক মোল্লা ও সোহাগ পরিবহনের খুলনার ইনচার্জ মো. ইয়ামিনও একই সুরে কথা বলেন। তারা জানান, পদ্মা সেতু চালু হলে যেহেতু পরিবহন খরচ বাড়বে, সেহেতু বাসভাড়াও বাড়াটা স্বাভাবিক। তবে, ভাড়া কী পরিমাণ বাড়বে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারেননি তারা।

তারা জানান, মালিকপক্ষ এ বিষয়ে এখনও তাদের কিছু জানাননি। সেতু উদ্বোধনের আগে কর্তৃপক্ষ মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেবে। সেতু চালুর পর আরিচা রুটের কিছু বাস মাওয়া রুটে চালানো হবে বলেও জানান কাউন্টার ম্যানেজাররা।

খুলনা জেলা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সোনা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সেতুর টোলসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা ভাড়া বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে। যদিও বিষয়টির ব্যাপারে স্ব স্ব পরিবহন মালিক সিদ্ধান্ত নেবেন। তারপরও ১০০ টাকার বেশি ভাড়া বাড়ানো ঠিক হবে না।’ তিনি সেতুর টোল কিছু কমাতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে মোটরসাইকেলপ্রতি ভাড়া ৭০ টাকা। সেতুর টোল হবে ১০০ টাকা। ফেরিতে কার/জিপ পার হতে লাগে ৫০০ টাকা, সেতুর ওপর দিয়ে পার হতে টোল দিতে হবে ৭৫০ টাকা। ফেরিতে পিকআপের ভাড়া ৮০০ টাকা, সেতুতে টোল হবে ১ হাজার ৩০০ টাকা। ফেরিতে ছোট বাসের ভাড়া ৯৫০ টাকা, সেতুর টোল ১ হাজার ৪০০ টাকা। মাঝারি বাস ফেরি পার হতে লাগে ১ হাজার ৩৫০ টাকা, সেতুর টোল ২ হাজার টাকা। ফেরিতে বড় বাসের ভাড়া ১ হাজার ৫৮০ টাকা, সেতুর টোল ২ হাজার ৪০০ টাকা। ফেরিতে ছোট ট্রাকের ভাড়া ১ হাজার ৮০ টাকা, সেতুর টোল ১ হাজার ৬০০ টাকা। ফেরিতে মাঝারি ট্রাকের ভাড়া ১ হাজার ৪০০ টাকা, সেতুতে টোল ২ হাজার ১০০ টাকা। ফেরিতে বড় ট্রাকের ভাড়া ৩ হাজার ৯৪০ টাকা, সেতুতে টোল দিতে হবে ৫ হাজার ৫০০ টাকা।

নূরুজ্জামান/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়