পদ্মা সেতু: আনন্দে ভাসছেন হকার-ঘাট শ্রমিকরাও
বেলাল রিজভী, মাদারীপুর || রাইজিংবিডি.কম
২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের মতো আনন্দে ভাসছেন এই রুটে কাজ হারাতে বসা হকার, শ্রমিকসহ কয়েক হাজার মানুষ। পদ্মার দুই পারে ফেরি ঘাট ঘিরেই যাদের জীবন-জীবিকা।
সরকারের কাছে তাদের দাবী পূনর্বাসন অথবা নতুন কর্মসংস্থনের। তবে তাদের জন্য মাদারীপুর জেলা প্রশাসক জানালেন আশার কথা। তিনি জানান, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হবে পর্যটন কেন্দ্র। সেখানেই হবে তাদের কর্মসংস্থান।
অনেকেই মনে করছেন, ২৫ জুনের পরই মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে সেই চিরচেনা হৈ হুল্লোর থাকবে না। পদ্মা পাড়ের ঘাট তখন হয়ে উঠবে সুনসান। কেউ আর এই পথে আসবে না সচরাচর। এতে করে ঘাটকে ঘিরে যাদের সংসারের চাকা ঘুরছে তারা হয়ে পড়বে কর্মহীন। যুগ যুগ ধরে আগলে রাখা পেশা হঠাৎ করেই ছাড়তে হবে তাদের। সংসারের চলতে থাকা চাকার গতি হঠাৎ করেই তখন কমে আসবে। তাই সেতু চালুর আনন্দের পাশাপাশি পেশা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিচ্ছে তাদের কপালে।
শিবচরের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ঘাটকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ হচ্ছেন ঘাটের হকার শ্রেণি। যারা লঞ্চ, ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করেন ঝালমুড়ি, ছোলা, সেদ্ধ ডিম, সিঙ্গারা, নারকেলচিড়া, শসা, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার। প্রতিটি লঞ্চে তিন থেকে চারজন করে নানান জিনিস নিয়ে ওঠেন হকাররা। ঘাটের পন্টুনে ঘুরে ঘুরেও বিক্রি করেন অনেকে। লঞ্চ, স্পিডবোট এবং ফেরিঘাটে ঘুরে ঘুরে অসংখ্য হকার শ্রেণি নানা রকম দ্রব্যাদি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ঘাট দিয়ে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রীই তাদের ক্রেতা। যাত্রীদের খুশি করে বিক্রি করাই তাদের কাজ। সেতু চালু হলে থাকছে না ঘাটের ব্যবহার। আর যাত্রী না থাকলে ব্যবসায়ও বন্ধ তাদের।
আলাপকালে ঘাটের হকাররা জানান, সেতু চালু হওয়ার খবর আনন্দের। এই সেতুর কারণেই আমাদের পদ্মাপাড়ে আজ এত উন্নয়ন। রাস্তা-ঘাট হওয়ায় ঘরে যেতে এখন আর কাদাপানি মাড়াতে হয় না। সব মিলিয়ে উন্নয়নের জোয়ার বইছে এই অঞ্চলে। তবে সেতু চালু হলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ঘাটের ওপর নির্ভর করে যুগযুগ ধরে চলা এই ব্যবসা হঠাৎ করেই থেমে যাবে। আর এটাই বাস্তবতা। কিছুটা মন খারাপ হলেও সেতু চালু আনন্দের বিষয়। বিকল্প পেশা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন অনেকেই। তবে ঘাটের মতো এতটা ভালো হবে কিনা তা জানা নেই।
বাংলাবাজার ঘাট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটের উভয় ঘাটেই রয়েছে অসংখ্য হকার। যারা একমাত্র ঘাটের নৌযানে ঘুরে ঘুরে বেচাবিক্রি করে থাকেন। লঞ্চ, ফেরি ও স্পিডবোটের যাত্রীরাই হকারদের একমাত্র ক্রেতা। আর এই ঘাট এলাকায় নানান জিনিসপত্র বিক্রি হয় অনায়াসেই। পদ্মাপাড়ের এলাকার খেটে খাওয়া মানুষেরাই ঘাটে হকারি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এদের মধ্যে মুখরোচক খাবার বিক্রেতাদের সংখ্যাই হবে কমপক্ষে ১ হাজার জন। তবে সরকারীভাবে এদের কোন তালিকা নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউবা রাত অবধি নৌযানে ঘুরে ঘুরে নানান খাবার-দাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। ঘাট না থাকলে এই পেশাও থাকছে না আর।
ইকবাল হোসেন। বাড়ি শিবচরের কাঠাঁলবাড়ি। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ঝাল মুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। দুই মেয়ে এক ছেলের সংসার। সাথে আছে বৃদ্ধ মা বাবা। তার আয়ের টাকাতেই সংসার চলে। তিনি বলেন, ‘আগে ঝাল মুড়ি বেচেই সংসার চালাইতাম। এখন পদ্মা সেতু চালু হলে আমারে কাজ কাম থাকবে না। আমরা তখন কি করমু? কেমনে বাচমু। সরকার যদি আমাদের জন্য কিছু করতো তাইলে আমাগো উপকার হইতো।’
বৃদ্ধা শুক্কুর মিয়া বাংলাবাজার ঘাটে পেঁপে বিক্রি করেন। তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে দাবী জানাই আমাদের মত কর্মহীন মানুষদের জন্য সরকার কিছু করুক।
হকার সাহেবালী মাঝি বলেন, ঘাট এলাকায় যারা হকারি করে সবাই গরীব মানুষ। আমরা কর্মহীন হলে আমাদের সংসার কেমনে চলবে? পদ্মা সেতু উদ্বোধনের খবরে আমরাও আনন্দিত কিন্তু যখন মনে হয় আমরা কাজ হারাবো তখন একটু খারাপ লাগে। সরকার বাহাদুরের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে আমাদের জন্য কিছু করার।
ঘাটে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে হকারি করেন স্বপন। কাঁঠালবাড়ী এলাকায় তার বাড়ি। ঘাটকে ঘিরেই তার বেড়ে ওঠা। সেতু চালু হবে, এ নিয়ে উচ্ছাসের শেষ নেই তার। তবে ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে তাতে ব্যবসাও বন্ধ, তাই কপালে চিন্তার ভাজ। তিনি বলেন, ঘাট এলাকার হকারদেরও পূনর্বাসন করা উচিত সরকারের। হঠাৎ করেই পেশা বদল করা যায় না। দীর্ঘদিনের পেশা বন্ধ হয়ে গেলে বিপাকে পড়তে হবে। হকারদের তালিকা করে সহজশর্তে ঋণ দিলে নতুন কিছু করতে পারবো।
তবে আশার কথা শোনালেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন। তিনি জানান, আগামীতে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নদী এলাকায় গড়ে তোলা হবে পর্যাটন কেন্দ্র। এই পর্যটন কেন্দ্রেই হকারসহ ঘাট কেন্দ্রীক যারা কর্মহীন হবে তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা হবে।
উল্লেখ্য, এই নৌরুটে ৮৭টি লঞ্চ, দেড় শতাধিক স্পিডবোট, ১৭ টি ফেরি বর্তমানে চলছে। এ সকল নৌযানে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী নিয়মিত পার হন। এই যাত্রীদের ওপর নির্ভর করেই চলছে কয়েক হাজার হকারের জীবন-জীবিকা।
/টিপু/