দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুয়ার খুলছে পদ্মা সেতু
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম
বাংলাদেশের ২৭ শতাংশ মানুষ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাস করে। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত এ অঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ। শনিবার (২৫ জুন) পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণে খুলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দুয়ার। সচ্ছলতা ফিরবে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বন্ধন হবে আরও দৃঢ়। পদ্মা সেতুর ইতিবাচক প্রভাবও পড়বে পরিবহন ও যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, তথ্য প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের ওপর।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই নয়, বৈচিত্র্য আসবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে। একদিকে যেমন দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হবে, ঠিক তেমনই এই সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে, পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে মৎস্য ও কৃষিজাত পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে। সেতুর কারণে কৃষকরা তার পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন। পাশাপাশি, প্রতিবেশী দেশ ভারত, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারের সঙ্গে এ দেশের সড়ক ও রেল সংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কৃষি খাত:
কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বলা হয় খাদ্যভাণ্ডার। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টন কৃষিপণ্য রাজধানীতে নেওয়া হয়। পদ্মা সেতুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন হলে সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে।
ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং সংরক্ষণ ও বিপণন সঙ্কটের কারণে খুলনা অঞ্চলে তরমুজচাষিরা তেমন লাভবান হন না। দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ চরে নারিকেল ও সুপারির চাষ হয়। সমতলে হয় পান ও তেজপাতার চাষ। পটুয়াখালীতে মুগ ডালের চাষ হয় বাণিজ্যিকভাবে। জাপানসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তা রপ্তানি করা হয়। প্রচুর ফুলের চাষ হয় যশোরে। এখানকার ফুলও রপ্তানি হয়। পদ্মা সেতুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে পণ্য পরিবহনে সুবিধা হবে। এতে কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাবেন কৃষকরা।
মৎস্য খাত:
দেশের দক্ষিণাঞ্চল মৎস্য চাষ ও আহরণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ি ও সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ আসে মূলত দক্ষিণাঞ্চল থেকে। সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে আছে অসংখ্য মাছের ঘের। সেখানে গড়ে উঠেছে অনেক মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। তাতে কাজ করছেন অসংখ্য দরিদ্র মানুষ। এখন মৎস্য খাত সংশ্লিষ্টরা উপকৃত হবেন।
মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে রাজধানীতে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১৪৫ থেকে ১৬০ টন মাছ নেওয়া হয়। এসব মাছের বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।
দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর মাছ উৎপাদিত হয়। বরিশালের ইলিশ, সুন্দরবনের নানা প্রজাতির মাছ ও বঙ্গোপসাগরেও আহরণ করা মাছ খুলনায় আসে। এখান থেকে মাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ বরফ দিয়ে ট্রাকে করে ঢাকায় নেওয়া হয়। এক দিনের মধ্যে মাছগুলো ঢাকা পৌঁছাতে না পারলে ভালো দাম পাওয়া যায় না। অনেক সময়ে ফেরিতে গাড়ি ওঠাতে ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ওই দিন ঢাকার বাজারে মাছ বিক্রি করা যায় না। পরের দিন বিক্রি করতে হয়। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। এখন আর এ সমস্যা থাকবে না।
মাছ পচনশীল। নির্দিষ্ট সময়ের পর এটি নষ্ট হয়ে যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে মাছের বিপণন ও বাজারজাতকরণ সহজ হবে। এতে জেলে, মৎস্য চাষি ও ব্যবসায়ীরা বেশি লাভবান হবেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিদেশে মৎস্য প্রেরণ সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত হবে। তাতে মাছের অপচয় হ্রাস পাবে। তাছাড়াও সুনীল অর্থনীতি হবে গতিশীল। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি পাবে মৎস্য খাত থেকে।
প্রাণিসম্পদ:
প্রাণিসম্পদ খাতে পদ্মা সেতুর প্রভাব হবে ইতিবাচক। সেতুটি চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুগ্ধ ও মাংস শিল্প বিকশিত হবে। গরু মোটাতাজাকরণ ও দুগ্ধ খামার গড়ে উঠবে। মাদারীপুরের টেকেরহাট এখন দুগ্ধ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এর পরিধি শরীয়তপুর, ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তাছাড়াও পোল্ট্রি শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। দানাদার খাদ্য সহজে পরিবহন করার কারণে এর মূল্য হ্রাস পাবে। খামারিরা প্রাণী-পাখি প্রতিপালনে আগ্রহী হবেন। দুধ ও মাংস প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটবে। তাতে বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থান। পরিবহন খরচ কমাতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরের অধিকাংশ পশু ব্যবসায়ী ট্রলারে করে পশু নিয়ে রাজধানীতে আসেন। অন্যদিকে, যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও ঝিনাইদহের ব্যবসায়ীরাও ট্রাকে করে গবাদিপশু ঢাকায় আনেন। পদ্মা পার হতে এসব ট্রাকের জন্য এতদিন ফেরিই ছিল ভরসা। বিড়ম্বনার সঙ্গে যুক্ত হতো বাড়তি খরচ। আবার ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে থাকতেন, অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডায় পশু আবার অসুস্থ হয়ে না যায়। অনেক সময় ফেরিঘাটে অসুস্থ গরু জবাই করে কম দামে মাংস বিক্রির নজিরও রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ বিভাগ আশা করছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা কমবে। আগে একটি ট্রাকে ২০টি গরু আনতে খরচ হতো ১৪-১৮ হাজার টাকা। এখন হয় ২২-২৫ হাজার টাকা। পদ্মা সেতুর ফলে কম ভাড়ায় ট্রাক পাওয়া যাবে। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে।
পাট শিল্প:
খুলনা থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার পাট রপ্তানি করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাট কিনে খুলনায় নিয়ে আসা হয়। এই পাট মোংলা বন্দর হয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পাট কিনে আনার সময় পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হয়। আবার খুলনার পাটকলে উৎপাদিত পাটজাত পণ্য রাজধানীতে নেওয়া হয়। এতে যে সময়ের অপচয় হয়, তার আর্থিক মূল্য অনেক বেশি। বিশ্ববাজারে পাটের অবস্থান ভালো করতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর এ খাত আরও এগিয়ে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খুলনার উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে এখন খুলনা অঞ্চল থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত কৃষিপণ্য পাঠানো সম্ভব হবে। তাতে কৃষকদের পণ্য বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত হবে।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব কুমার পাল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৩০ হাজার টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। কিন্তু, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বা অন্য কোনো কারণে ফেরিঘাটে বেশি সময় ব্যয় হলে বরফ গলে গিয়ে চিংড়ি নষ্ট হয়। পদ্মায় ফেরির যানজটের কারণে অনেক সময় দুই দিনও দেরি হয়। তখন চিংড়িতে দেওয়া বরফ ফুরিয়ে যায়। এতে চিংড়িতে ব্যাকটেরিয়া জন্মে। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সমস্যা আর থাকবে না। সকালে পাঠানো চিংড়ি বিকেলে রাজধানীতে বিক্রি করা যাবে।
নূরুজ্জামান/রফিক