ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১২ ১৪৩১

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই আইনজীবী হতে চায় তানিয়া

শাহীন রহমান, পাবনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৭, ২৭ জুলাই ২০২২  
প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই আইনজীবী হতে চায় তানিয়া

আইনজীবী হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা তানিয়ার

সমাজের শত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার তানিয়া খাতুন। তাকে দেখতে সাত-আট বছরের শিশুর মতো দেখালেও তিনি আসলে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। 

পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানোর পাশাপাশি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তানিয়া। তার সেই স্বপ্ন পূরণে তাই সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা চেয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার হাপানিয়া গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর তাজুল ইসলাম ও নাছিমা খাতুন দম্পতির মেয়ে তানিয়া খাতুন। তিন ভাই বোনের মধ্যে তানিয়া সবার বড়। প্রথম দেখায় তানিয়াকে যে কারো মনে হবে সাত-আট বছরের শিশু। কিন্তু জন্ম সনদের তথ্য অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ১৯ বছর। 

আরো পড়ুন:

২০০৩ সালে জন্ম হয় তানিয়ার। কিন্তু বয়স অনুপাতে তার শারীরিক গঠন হয়নি। দিন যতো গড়িয়েছে দুশ্চিন্তা জেঁকে বসে তারা বাবা-মায়ের মনে। তানিয়াকে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করিয়েও সুফল পাননি তারা। তবে, তানিয়ার প্রবল ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মেনেছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। 

সমাজের বাঁকা চোখ ও কটু কথা উপেক্ষা করেই তানিয়া চালিয়ে গেছেন শিক্ষা জীবন। ২০১৯ সালে বেরুয়ান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০২১ সালে বেরুয়ান মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। বর্তমানে তানিয়া আটঘরিয়া সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। 

তানিয়া খাতুন বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি শারীরিকভাবে বেড়ে উঠছিনা বলে জানতে পারি। তখন থেকেই খারাপ লাগে আমার। আমার পাশের অনেক মানুষই অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি বড় হচ্ছি না, এতটুকুই রয়ে গেছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘চলাফেরার পথে সবাই কেমন করে আমার দিকে তাকায়। নানা রকম কথা বলে। আমি কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারি না, কথা বলতে পারি না। আমি ছোট, এটা কি আমার অপরাধ। লেখাপড়া করে একটা ভালো চাকরি করে বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই আমি। আইনজীবী হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখি আমি।’ 

তানিয়া খাতুনের বাবা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে আমার হাজারো স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এখন তাকে নিয়ে সবসময় সবার কাছে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। সবাই হাসাহাসি করে, এতটুকু মেয়েকে কোনোদিন বিয়ে দিতে পারবো না বলেও অনেকে বলেন। তানিয়ার বয়সী অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে সন্তান হয়ে গেছে। এর চেয়ে বাবা হিসেবে কষ্টের কি আছে বলেন?’

তানিয়ার মা নাছিমা খাতুন বলেন, ‘অন্য  শিশুদের মতোই তানিয়ার স্বাভাবিক জন্ম হয়। খেয়াল করে দেখি তার বয়সী অন্য শিশুরা শারীরিকভাবে বেড়ে উঠলেও তানিয়া বাড়ছে না। তখন টাকা পয়সা খরচ করে বিভিন্ন ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি। ডাক্তার বলছে, তানিয়ার রক্ত কনিকার সমস্যা।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘তানিয়ার ব্রেন ভালো। তাই ওকে কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছি। তানিয়া আইনজীবী হতে চায়। আমাদের সে সামর্থ্য নাই। তাই স্থানীয় কলেজে ভর্তি করেছি। সবাই যদি সহযোগিতা করেন তাহলে তানিয়ার জীবনটা সুন্দর হতে পারে।’

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সালেহ মুহাম্মদ আলী বলেন, ‘আধুনিক চিকিৎসায় অনেক মানুষ প্রতিবন্ধকতকে জয় করে স্বাভাবিক হয়েছেন। তানিয়ার দুর্ভাগ্য হয়তো অর্থাভাবে তার চিকিৎসা হয়নি। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা যদি মানসিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে তানিয়ার পাশে দাঁড়ান তাহলে তানিয়ার জীবন সুন্দর হতে পারে।’ 

আটঘরিয়া সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শরিফুল আলম বলেন, ‘কলেজে ভর্তি থেকে শুরু করে বেতন, বইসহ সব সুযোগ সুবিধা তানিয়ার জন্য ফ্রি করে দিয়েছি। আগামীতেও তার শিক্ষাজীবনে যেকোনো সহযোগিতায় কলেজ কর্তৃপক্ষ পাশে থাকবে। তানিয়া যাতে কোনো কারণে মনে কষ্ট না পায় সেদিকে সব শিক্ষককে খেয়াল রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

আটঘরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম বলেন, ‘তানিয়ার মানসিক শক্তি অনেক বেশি। যে কারণে সে অনার্সে লেখাপড়া করতে পারছে। ওর বিষয়ে জানার পরই তাকে শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছি। তানিয়ার চিকিৎসার সব ব্যয় আমরা বহন করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার পরিবারকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তানিয়া যাতে মনে না করে সে সমাজের বাইরের কেউ, সে লক্ষ্যে সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

শাহীন/ মাসুদ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়