জয়পুরহাটে টিকে আছে শুধু ‘পৃথিবী সিনেমা হল’
মো. শামীম কাদির, জয়পুরহাট || রাইজিংবিডি.কম
জয়পুরহাট জেলা শহরের আরামনগর মহল্লার আব্দুস সালাম। তরুণ বয়সে চুপিসারে হলে সিনেমা দেখার স্মৃতিচারণ করে তিনি জানান, অনেক আগের কথা। মা-বাবাকে না বলে স্কুলের ব্যাগে বাড়ি থেকে চাল নিয়ে তা বিক্রি করে, কখনো বাবাকে না জানিয়ে তার পকেট থেকে টাকা নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতেন। সেদিনের সাদা-কালো সিনেমা তাকে মুগ্ধ করতো। অতিথি, অরুণ বরুণ কিরণমালা, সাত ভাই চম্পা, শাপমোচন— এমন সুন্দর সুন্দর সিনেমা হতো তখন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেই সব সিনেমা দেখা যেত। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সালাম বলেন, ‘এসব এখন শুধুই স্মৃতি’।
শুধু আব্দুস সালাম নন, থানাপাড়া এলাকার অশোক কুমার গৌড়, কালাই উপজেলার মোলামগাড়িহাটের মোহাম্মদ আলী, আক্কেলপুর পৌর সদরের আমুট্ট গ্রামের ছিদ্দিকুর রহমানসহ পঞ্চাশোর্ধ্ব কয়েকজন জানান, ওই সময়ে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল সিনেমা হল। পারিবারিক কাহিনী নির্ভর সিনেমা দেখতে পরিবারের সবাই হলে যেত। সেই সিনেমা দেখে দর্শকরা হাসত, কাঁদত।
ষাট, সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত দাপিয়ে চলা বাংলা সিনেমার এথন মন্দাভাব। এক সময়ে জয়পুরহাটে রমরমা ব্যবসা করা সিনেমা হলগুলো বন্ধ হতে বসেছে। ১৬/১৭টি প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে এখন নিভু নিভু করে চলছে মাত্র একটি। সিনেমা ব্যবসার জড়িত মানুষের এখন করুণ অবস্থা।
জেলার ১৭টি সিনেমা হলের মধ্যে জেলাশহরের রবি টকিজ ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। চিত্রা সিনেমা হল ১৯৮২ সালে; নাজনীন, আনন্দ (পূর্ব নাম ভারতী টকিজ), নাজমা ও পৃথিবী সিনেমা হল ১৯৮৩ সালে; কালাই উপজেলাশহরে হাসনা হেনা সিনেমা হল ১৯৮৩ সালে; একই উপজেলার মোলামগাড়ী হাটে বিধিলিপি হল ১৯৯৫ সালে; ক্ষেতলাল উপজেলায় রীতি সিনেমা হল ১৯৯০ সালে; আক্কেলপুর উপজেলাশহরে আয়না হল ১৯৮৭ সালে; একই উপজেলায় পলাশ সিনেমা হল ১৯৯১ সালে; পাঁচবিবি উপজেলা শহরে রূপালী সিনেমা হল ১৯৭৯ সালে; সদর উপজেলার জামালগঞ্জ বাজারে একটি ও মঙ্গলবাড়ী বাজারে একটিসহ জেলায় ১৭টি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ সবের মধ্যে রবি টকিজ, নাজমা, রূপালী, আয়না সিনেমা হল ছাড়াও মঙ্গলবাড়ী বাজারে, জামালগঞ্জ বাজারের মোট ৬টি সিনেমা হল বন্ধ হলেও সেখানে এখন ভবন দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কোনোরকমে ঠিকে আছে জেলাশহরের পৃথিবী সিনেমা হল। দর্শকরা সিনেমা বিমুখ হওয়ায় লোকসানে পড়ে বাকি সব হল একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিটিও কতদিন ঠিকে থাকবে তা নিয়ে শঙ্কায় সংশ্লিষ্টরা।
এখন টিভি, ইউটিউবে অতিসহজে সিনেমা দেখা যায়। বিনোদনের জন্য আছে ফেসবুক, নাচ, গান, কনসার্ট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি। এর সঙ্গে বাংলায় সিনেমায় অশ্লীলতার কারণে এখন আর কেউ হলে যেতে চায় না। দিনে দিনে হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সিনেমা হল বন্ধ হওয়ায এর সঙ্গে জড়িত মানুষের এখন দুর্দিন। তারা জানান, হল বন্ধ হওয়ায় সেই সময়ে সাধারণের কাছে সমাদৃত মানুষগুলো পেশা পরিবর্তন করে ফেলছেন। অনেকে কোনো কাজ করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আনন্দ সিনেমা হলের গেটম্যান গোপাল চন্দ্র রায়, নাজমা সিনেমা হলের ম্যানেজার রানা, নাজনীন সিনেমা হলের গেটম্যান আব্দুল মালেক, হাসনা হেনা সিনেমা হলের মেশিন অপারেটর শহিদুল ইসলাম জানান, আগে সিনেমা হলের কর্মচারী হওয়ার কারণে সমাজে তাদের কদর ছিল। এখন সেই দিন নেই। এখন তাদের কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে, কেউ চা-পানের দোকান দিয়ে কোনোরকমে দিন পার করছে।
সিনেমা ব্যবসার মন্দাভাব কাটাতে প্রেক্ষাগৃহগুলোর আধুনিকায়নের কথাও ভাবছেন কোনো কোনো হল মালিক। তবে এর জন্য প্রয়োজন বড় অংকের বিনিয়োগ। তারপরও এখন একই ধরনের গল্প আর নকল সিনেমা দর্শকদের কতটুকু টানবে তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। তবে সহজশর্তে ঋণ পাওয়া গেলে এ ব্যবসার আরও চেষ্টা করে দেখতে চান স্থানীয় সিনেমা হল মালিকদের অনেকে।
আয়না সিনেমা হলের মালিক আবুল কালাম আকন্দ, রূপালী সিনেমা হলের মালিক আবু তালেব বাবু চেীধুরী, পৃথিবী সিনেমা হলের মালিক এস এম সুমন বলেন, ইউটিউবে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ, সিনেমা হলে আধুনিকীকরণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, অশ্লীল সিনেমা নির্মাণ-প্রদর্শন বন্ধ ও সীমিত আকারে বিদেশি সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হলে দেশের চলচ্চিত্র ব্যবসা আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।
স্থানীয় মঞ্চশিল্পী ও শান্তিনগর থিয়েটারের সভাপতি মিজানুর রহমানসহ জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলেন, নকল সিনেমা, দুর্বল গল্প, সিনেমা হলের সেকেল অবস্থা— এমন সব নানা কারণে চলচ্চিত্র ধ্বংসের মুখে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন সঠিক গবেষণা এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ। এতে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের এগিযে আসতে হবে।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক শরীফুল ইসলাম বলেন, জয়পুরহাটে যে সব সিনেমা হলের ভবন রয়েছে, এই সকল সিনেমা হল মালিকরা যদি আবারও ব্যবসায় আগ্রহ দেখান, তবে সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব সহযোগিতা দেওয়া হবে।
/বকুল/