রসে টসটসে মুখে জল আনে তালমন
মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
পাকা তালের ঘ্রাণে মুগ্ধ হয় সবাই। বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরা মৌসুমি এই ফল অনেকেরই প্রিয়। ভাদ্র মাসে অনেকের ঘরেই এই ফল দিয়ে তৈরি হয় পিঠা-পায়েস। তবে তাল দিয়ে বিভিন্ন পদও তৈরি করা যায়। তেমনই একটি পদ তালমন।
আকারে ছোট ও রসে টসটসে হওয়ায় যে কারও মুখেই জল আনে তালমন। মৌসুমি এই মিষ্টি শুধুমাত্র ভাদ্র-আশ্বিন মাসেই তৈরি করা হয়। বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, মুক্তাগাছার মন্ডা অথবা নাটোরের কাঁচা গোল্লার মতোই জনপ্রিয় হবিগঞ্জের তালমন।
ভোজনরসিকদের রসনা তৃপ্ত করে চলেছে হবিগঞ্জ জেলা শহরের চৌধুরী বাজারের সফিক মিয়ার তৈরী তালমন। স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতিতেও অনন্য স্থান দখল করে আছে মিষ্টান্নটি।
তালমন তৈরীতে চিনি, তেল, তাল ও ময়দার ব্যবহার করেন সফিক মিয়া। তালমন তৈরীতে দৈনিক ২০ থেকে ২৫টি তাল ব্যবহার করেন তিনি। জনপ্রিয় এ মিষ্টিটি প্রতিকেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোনো প্রকারের কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ কজি তালমন বিক্রি করছেন সফিক মিয়া খুব সহজেই।
মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে তালমন পাঠানো একটি ঐতিহ্য
শরৎকাল এলে মিষ্টির বাজারে তালমনের আগ্রাসন চোখে পড়ার মতো। এ সময় জেলা শহরের চৌধুরীবাজারের সফিক মিয়ার দোকান তো বটেই পুরো হবিগঞ্জে অন্যান্য মিষ্টির চাহিদা কমে জয়জয়কার চলে তালমনের। সহজলভ্য উপকরণ এবং জনপ্রিয়তার কারণে এ মৌসুমে তালমন বিক্রি হতে দেখা যায় জেলা ও উপজেলা সদর ছাড়িয়ে গ্রামের বাজার পর্যন্ত।
চলছে ভাদ্র মাস। ইতিমধ্যে হবিগঞ্জের বাজার দাপাতে শুরু করেছে সফিক মিয়ার তৈরী তালমন। সকালের নাশতা, সাধারণ আড্ডা, বিয়ে-বউভাত, পারিবারিক-সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে তালমনের রয়েছে গৌরবময় উপস্থিতি।
শরৎকাল এলে মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য তালমন পাঠানো একটি ঐতিহ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়ের বাবা নিজে বেয়াই-বেয়াইনের জন্য তালমন নিয়ে যান। ভাদ্র-আশ্বিন মাসের এই তালমন নিয়ে হবিগঞ্জের সর্বত্র আগ্রহ বরাবরের। মিষ্টির দোকান ও রেস্টুরেন্টগুলোতে তাই লাইন দিয়ে কিনতে দেখা যায় মিষ্টিটিকে।
শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন- এই তিন মাসজুড়ে থাকে বাঙালির ঘরে ঘরে তালের পিঠা। এলাকাভেদে এই তালের পিঠারও ভিন্নতা রয়েছে। হবিগঞ্জের সর্বত্র তালের ভাপা পিঠা, তালের ভাজা পিঠা, তালের খোলা পিঠা (তাওয়ায় রান্না করা) তৈরি হয়। তবে তালমন তৈরি সে অর্থে ঘরোয়া নয়, বাজারি। মিষ্টান্ন বলেই এর সামাজিক উপস্থিতিও লক্ষণীয়।
তালমনে আগ্রহ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা সুমন মিয়া বলেন, ‘কিছুদিন আগে বোনের বাড়িতে তালমন নিয়ে যাই। এর স্বাদ পেয়ে বোন আবদার করেছে আবার পাঠানোর জন্য। আর সে জন্যই তিন কেজি তালমন কিনতে এখানে আসা।’
তালমনের বিক্রেতা সফিক মিয়া বলেন, ‘ভালোমানের তাল কিনে আনা হয় নরসিংদী থেকে। তাল থেকে রস বের করে প্রথমে ময়দা ও চালের গুঁড়ার সঙ্গে মিশিয়ে রাখা হয়। পরে চুলার আগুনে কড়াইয়ের গরম তেলে ভালো করে ভেজে নিয়ে চিনির সিরায় রাখা হয় কিছুক্ষণ। পর্যায়ক্রমে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী দিনভর চলতে থাকে গরম তেলে তালমন ভাজা ও সিরা মেশানো।’
তিনি আরো বলেন, ‘এক কেজি তালমন তৈরিতে খরচ হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকা। বিক্রি করছি ১২০ টাকায়। আর তালের বীজগুলো বিনামূল্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন লোকজনকে দিয়ে দেই। এ বীজ থেকে তাল গাছ করে রোপণ করা হয়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘হবিগঞ্জের অনেক ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে। তালমন সেই সংস্কৃতিতে মিশে আছে। লোকজনের কাছে সফিক মিয়ার তৈরী তালমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে যে হারে তালগাছ কমে যাচ্ছে, তাতে তালমনের সংস্কৃতি ধরে রাখা ভবিষ্যতে কঠিন হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পরিবেশের ভারসম্য রক্ষার জন্য হলেও এখন বেশি করে তাল গাছ রোপণ করা প্রয়োজন। তাল গাছে শুধু তাল পাওয়া যায় না, এ গাছটি বজ্রপাত প্রতিরোধ করে।
মাসুদ