পদ্মা-গড়াইয়ের সংসারে এখনো আসেনি নতুন অতিথি
রাজশাহী সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
সকালের মিষ্টি রোদে পানিতে পাশাপাশি ভেসে বেড়ায় পদ্মা ও গড়াই। তবে খুব কম সময়ের জন্য। একটু শব্দ হতেই দুজন চলে যায় পানির গভীরে। আর দেখা যায় না তাদের। ৩৭ বছর বয়সী পদ্মা এবং ৪২ বছর বয়সী গড়াইয়ের সংসার পাঁচ বছরের। তবে তাদের এই সংসারে এখনো আসেনি কোনো নতুন অতিথি।
পদ্মা ও গড়াইয়ের বসবাস রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার পুকুরে। পদ্মা ও গড়াই মূলত মিঠাপানির বিরল প্রজাতির ঘড়িয়াল।
মিঠাপানির এই প্রজাতি এখন বিলুপ্তির পথে। তাই তাদের বাঁচাতে ও প্রজননের জন্য উদ্যোগ নেয় রাজশাহী ও ঢাকা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষে। এ কাজে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)।
প্রজনন করানোর জন্য পদ্মা ও গড়াইকে রাখা হয় একসঙ্গে। দুজনের ভাব জমতেই লেগে যায় দেড় বছর। এরপর আরও সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের সংসারে কোনো নতুন অতিথির আগমন ঘটেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর এই চিড়িয়াখানায় আগে দুটি মাদি ঘড়িয়াল ছিল। ১৯৮৫ সালের দিকে একজন জেলের জালে ধরা পড়ে ঘড়িয়াল দুটি। জেলের কাছে থেকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় সংরক্ষণ করা হয় তাদের। তখন একজনের নাম দেওয়া হয় পদ্মা, অপরজনের নাম রাখা হয় যমুনা। দুইজনই মাদি হওয়ায় প্রজনন সম্ভব ছিল না। অপরদিকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় চারটি পুরুষ ঘড়িয়াল ছিল। কিন্তু মাদি ঘড়িয়াল না থাকায় সেখানেও প্রাণীগুলোর প্রজনন সম্ভব হচ্ছিল না। তাই প্রজননের কথা চিন্তা করে রাজশাহী চিড়িয়াখানা ও ঢাকা চিড়িয়াখানার মধ্যে ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট ঘড়িয়াল বিনিময় করা হয়।
সেদিন পদ্মার দীর্ঘ ৩২ বছরের সঙ্গী যমুনাকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয়। আর ঢাকা থেকে গড়াইকে এনে পদ্মার কাছে দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় তাদের নতুন জীবন। সে সময় পদ্মা আর গড়াইয়ের ‘বিয়ে’ নিয়ে চিড়িয়াখানায় উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
তবে পদ্মা ও গড়াইয়ের সংসার জমতে সময় লেগেছিল প্রায় দেড় বছর। দীর্ঘ এই সময় ধরে দুজন দুজনের কাছে আসতো না। দূরে দূরে সরে থাকতো। তাই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দিতে অভিনব কৌশল বেছে নেয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, পদ্মা ও গড়াইকে নিয়ে তারা খুব চিন্তায় ছিলেন। দুটি ঘড়িয়াল মারামারি করতো। তাই প্রথমে দুই জায়গায় খাবার দেওয়া হতো। এরপর ধীরে ধীরে খাবার দেওয়ার জায়গার মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনা হয়। একপর্যায়ে দেখা গেল, পদ্মা ও গড়াই আর মারামারি করে না। তখন এক জায়গায় খাবার দেওয়া শুরু করা হয়। এভাবে এক জায়গায় খাবার খেতে খেতে তাদের মধ্যে ভাব জমে ওঠে। দু‘জন দু’জনার কাছাকাছি থাকে সব সময়ের জন্য। একসঙ্গে খাবার খায়। একসঙ্গে রোদে গা পোড়ায়। কিন্তু যে আশায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দু’জনের মিলন ঘটিয়েছে, সেই আশা এখনো পূরণ হয়নি।
২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরপর তিন বছর ধরে পদ্মা ডিম দিয়েছে। তবে সেই ডিম থেকে বাচ্চা হয়নি।
ঘড়িয়ালের নতুন বাচ্চার দেখা পাওয়া না গেলেও এখনো আশাবাদী রাজশাহী চিড়িয়াখানার কিউরেটর ও ইনচার্জ ফরহাদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ঘড়িয়ালের বাসস্থানের মধ্যেও আমরা আইল্যান্ড করে দিয়েছিলাম। যাতে সেখানে ডিম পাড়তে পারে। কিন্তু পরপর তিনবার পদ্মা পানিতে ডিম দিয়েছে। যার কারণে কোনো ভাবেই বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে যমুনা ডিম দিয়েছে কিনা সে খবর আমরা পাইনি। কিন্তু এখানে দিলেও বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। তাই আমরা ঘড়িয়ালের বাসস্থানের দিকে আরও মনোযোগ দিয়েছি। পুকুরের মাঝখানে ডিম দেওয়ার জন্য যে বালুর ঢিবি সেটা আরও উঁচু করা হবে। যাতে সেখানে পদ্মা ডিম পাড়তে পারে। তাছাড়া একটা ইনকিউবেটর নেওয়া হয়েছে। ডিম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাখা হবে সেখানে। দেশে এর আগে কোথাও ঘড়িয়ালের ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’ হয়নি। রাজশাহীতে যদি সফল হয় তবে এটি একটি ইতিহাস হবে।’
আইইউসিএনের তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে ঘড়িয়াল টিকে আছে ২০০টির কম। এরা বন্য পরিবেশে ৫০-৬০ বছর বেঁচে থাকে। কোনো কোনোটি ১০০ বছর পর্যন্তও বাঁচতে পারে। একেকটি ঘড়িয়াল সাধারণত ৫-৬ মিটার লম্বা হয়। কুমির জাতীয় প্রাণীর মধ্যে এরা দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি। বর্তমানে সারা বাংলাদেশের তিনটি চিড়িয়াখানা এবং একটি সাফারি পার্ক মিলিয়ে মোট ১২টি ঘড়িয়াল আবদ্ধ পরিবেশে জীবিত আছে।
শিরিন সুলতানা/ মাসুদ