২১ হাজারের বেশি সাপের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বোরহান
শিরিন সুলতানা কেয়া || রাইজিংবিডি.কম
সাপ হাতে বোরহান বিশ্বাস
কমলা রঙের রেড কোরাল কুকরী সাপটি হাতের ওপর নড়াচড়া করছে। হঠাৎ আঙ্গুলের কাছে দাঁত বসিয়ে দিল সাপটি। বোরহান বিশ্বাস রমনের হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। হাসিমুখে বোরহান বললেন, ‘আজ মনে হয় কোন কারণে একটু বিরক্ত। তাই কামড় বসালো।’
এক যুগের বেশি সময় ধরে সাপ নিয়ে গবেষণা করছেন বোরহান বিশ্বাস। এ পর্যন্ত বাঁচিয়েছেন ২১ হাজারের বেশি সাপের প্রাণ। সাপদের আচার-আচরণ তাঁর ভালই জানা। এই যে রেড কোরাল কুকরী সাপটি কামড় বসালো, তার আগে বাংলা কোনো নাম ছিল না। পঞ্চগড় থেকে আহত অবস্থায় এই প্রজাতির একটি সাপ উদ্ধার করেছিলেন বোরহান। দীর্ঘ সেবায় সাপটিকে তিনি সুস্থ করে তোলেন। তারপর তিনিই এর বাংলা নাম দেন ‘কমলাবতী’। এই নামে এটি বাংলাদেশের সাপ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
বোরহান বিশ্বাসের বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার আফিনেপালপাড়া গ্রামে। সাপের প্রতি ভালবাসা থেকে ২০০৯ সালে পবার ধর্মহাটা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টার’। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আহত সাপ উদ্ধার করে এখানে চিকিৎসা করেন। সাপ নিয়ে গবেষণা করেন। বোরহানের গবেষণা দেখে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার তাঁকে কয়েক বছর আগে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে।
বোরহান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া দেশের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন তিনি। এসব থেকে যা সম্মানি পান তা দিয়ে চলেন। ছুটে বেড়ান সাপ উদ্ধারে। এ জন্য অপেক্ষা করেন ফোনকলের। কোথাও আহত কিংবা আটকে থাকা সাপের খবর এলেই ছুটে যান তা উদ্ধার করতে। নিয়ে আসেন নিজের রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারে। সাপেদের বন্ধু হয়ে তাদের সেবা-সুশ্রুশা করেন। তারপর বন্য পরিবেশে ছেড়ে দেন।
আঁকাবাঁকা গ্রামীণ পথ বেরিয়ে গত বুধবার বিকালে ধর্মহাটা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, নির্জন মাঠে ইটের দেয়াল আর টিনের ছাউনি দিয়ে বোরহান বিশ্বাস গড়ে তুলেছেন তার স্নেক রেসকিউ অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টার। ভেতরে সাপ রাখার জন্য কংক্রিট দিয়ে বানানো হয়েছে সার্পেন্টেরিয়াম। এর মধ্যে সাতটি বড় ও আটটি ছোট সার্পেন্টেরিয়াম আছে। এসব সার্পেন্টেরিয়ামে এখন সাপ আছে ১৪টি।
ভয়ঙ্কর বিষধর সাপ রাসেল ভাইপারও আছে। তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা পৌর এলাকা থেকে ২০ দিন আগে একে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। এছাড়াও আছে পাঁচটি খৈইয়া গোখরা সাপ। এগুলো বিভিন্ন বাড়ি থেকে উদ্ধার করে এখানে আনা হয়েছে। এছাড়াও সেখানে তিনটি পদ্ম গোখরা, একটি কালাচ, দুটি রেড কোরাল কুকরী বা কমলাবতী এবং দুটি সবুজ বোরা সাপ আছে। চিকন সবুজ রঙের এই সবুজ বোরা সাপগুলো সিলেট থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। কমলাবতী দুটি উদ্ধার হয়েছে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও থেকে।
বোরহানের গবেষণাগারে আছে কিছু মৃত সাপও। একপাশে তিনটি বয়ামে রাখা আছে মৃত সাপ চারটি। এগুলোর মধ্যে একটা শঙ্খিনী, একটা কালকেউটে ও দুটি গোখরা। প্রায় ১০ বছর আগে সাপগুলো মারা গেছে। সেগুলো বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা আছে এখানে গবেষণার জন্য।
বোরহান জানালেন, প্রথম দিকে তার কনজারভেশন সেন্টার নিয়ে লোকজন অবহেলা করতেন। এই সেন্টার এখন সবার কাছেই হয়ে উঠেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই ফোন করেন। সাপ কামড়ালে কী করতে হবে কেউ জানতে চান। আবার বাসা বাড়িতে সাপ বের ঢুকে গেলে ধরে নিয়ে তার সেন্টারে রাখার অনুরোধ করেন।
বুধবার (১৩ অক্টোবর) বোরহানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা নেমে আসে। নির্জন মাঠের ওই এলাকায় ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে। এদিকে টর্চের আলোর কারণে সার্পেন্টেরিয়ামের ভেতর ফোস ফোস করতে থাকে খৈইয়া গোখরার দল। বোরহান বিশ্বাস তাঁর সবগুলো সাপই দেখালেন। এরমধ্যেই একটা ফোন এলো তার মোবাইলে। শ্রীমঙ্গলের বন্যপ্রাণি সেবাশ্রমের এক কর্মকতা ফোন করেছেন। জানালেন, চারদিন আগে শ্রীমঙ্গলে একজনকে সবুজ বোরা সাপ কামড় দিয়েছে। এখন তার পা ফুলে গেছে। করণীয় কী?
বোরহান বললেন, দ্রুতই লোকটিকে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। দেরি করলে পা কেটে ফেলতে হতে পারে। বোরহান এই ফোন কাটতেই আরেক কল আসে পাশের গ্রাম থেকে। জানানো হয়, এক বাড়িতে সাপ ঢুকেছে।
বোরহান জানালেন, রোজ পরামর্শের জন্য অন্তত ২৫-৩০টি ফোন আসে তার কাছে। সবাইকেই পরামর্শ দেন। সাপ উদ্ধার করার জন্যও অনেক ফোন আসে। কোথাও নিজেই যান, আবার কোথাও তাঁর সহযোগী আল আমিন হোসেন ইথার বা শেখ ফরিদকে পাঠান।
বোরহান বিশ্বাস জানান, ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি তাঁর সেন্টারটির যাত্রা শুরু করেন। এই দীর্ঘ ১৩ বছরে ২২ হাজারের বেশি সাপ উদ্ধার করেছেন। এর মধ্যে ২১ হাজার সাপ সুস্থ করার পর ছেড়ে দিয়েছেন প্রাকৃতিক পরিবেশে। ৩০০টি সাপ গবেষণার জন্য ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দিয়েছেন। বাকি ৭০০ সাপ উদ্ধারের আগে-পরে মারা গেছে।
বোরহান বলেন, ‘প্রথম দিকে সাপ উদ্ধার করা মূল কাজ হলেও এরপর আমরা গবেষণার সাথে যুক্ত হই। এখন সাপের ডিএনএ, জিনতত্ত্ব এবং ভেনম নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছি। আমাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এন্টিভেনম নিশ্চিত করা। ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সাথে আমি যুক্ত আছি। বাংলাদেশে এন্টিভেনম তৈরির কাজ চলছে। সেই গবেষণার সাথেও যুক্ত থেকে কাজ করছি। সাপে কাটার সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা আমাদের স্বপ্ন।’
বোরহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে অনার্স এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। এমফিল করেছেন সিঙ্গাপুরে। এর আগেই ভারত ও থাইল্যান্ড গিয়ে সাপ ধরার প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। তারপর নিজের গ্রামে গড়ে তুলেছেন সাপ উদ্ধার ও সংরক্ষণ কেন্দ্র। তাঁর কেন্দ্রে থাকা সাপগুলোর একটিরও বিষদাঁত ভাঙা নেই।
রাজশাহী/সনি