ঢাকা     বুধবার   ২০ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৫ ১৪৩১

ভুতুরে বিলে দিশেহারা আশ্রায়ণের ৪০ পরিবার

কাওছার আহমেদ, টাঙ্গাইল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ২৭ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ১০:৪৭, ২৭ নভেম্বর ২০২২
ভুতুরে বিলে দিশেহারা আশ্রায়ণের ৪০ পরিবার

চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্র।

প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের আশ্রয়কেন্দ্রে ভুতুরে বিদ্যুৎ বিলের উপদ্রবে দিশেহারা হয়ে পরেছেন গৃহহীন ৪০ পরিবার। সহায় সম্বলহীন হওয়া সত্বেও বিদ্যুৎ বিলের ভোগান্তির শিকার এখন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চিলাবাড়ী আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ওই পরিবারগুলো। বিলাসী জীবন না হওয়া সত্ত্বেও প্রায় প্রতি মাসে তাদের গুণতে হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল। 

বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে এমন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন গৃহহীন ওই পরিবারগুলোর সদস্যরা। এছাড়া পয়ঃনিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা, যাতায়াত ব্যবস্থা ও গৃহনির্মাণে ত্রুটিসহ নানা সমস্যার কথাও তুলে ধরে সমস্যা সমাধানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিদ্যুৎ বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়।

আরো পড়ুন:

সরেজমিনে দেখা যায়, দুই বছর যাবৎ চিলাবাড়ী আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাস করছেন ৪০টি পরিবারের প্রায় দেড় শতাধিক সদস্য। ২ শতাংশ জমিসহ উপহারের ঘরে বসবাস করার পাশাপাশি বাড়তি জমিতে তারা পেঁপে, লাউ, বটবটি, কাঠালসহ নানা প্রজাতির ফলজ ও সবজির আবাদ করেছেন। দৈনিক উপার্জনের টাকা আর সবজিই দিচ্ছে তাদের খাওয়ার যোগান।

চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসরত গৃহিনী তিসার বৈদ্যুতিক কাস্টমার নম্বর-৯৭০৯২৭৬৪ ও মিটার নম্বর-১৬৮০৪০। তার অভিযোগ, ‘চলতি বছরের ২৮ আগস্ট বিদ্যুৎ বিল ১ হাজার ৬৭০ টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ১ হাজার ৯১৫ টাকা আর অক্টোবর মাসে বিল এসেছে ১ হাজার ৩৯৫ টাকা। প্রতি মাসে এই পরিমাণ টাকার বিল আসলেও আশ্রয় কেন্দ্রের কোনো কোনো বাড়িতে বিলই দেওয়া হচ্ছে না। ভুতুরে ওই বিদ্যুৎ বিলের কারণে আমি চরম ভোগান্তির মধ্যে আছি। বিদ্যুৎ বিলের টাকা পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে।’

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রে বসবাসরত আমাদের এই অংশের ১০ ঘরের জন্য একটি টিউবওয়েলের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দের টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন থাকায় পানি ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়াও এখানে ড্রেন ও যাতায়াতের রাস্তা নেই। এ কারণে ব্যবহৃত পানি যাচ্ছে অন্যের জমিতে আর হাটা চলাও করতে হচ্ছে অন্যের জমির উপর দিয়ে। ব্যবহৃত ওই পানি আর হাটা চলার কারণে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিবেশীদের কটু কথা শুনতে হচ্ছে।’

গৃহিনী শাহনাজের বৈদ্যুতিক কাস্টমার নম্বর- ৯৭০৯০৫৬০ ও মিটার নম্বর- ১০৭০৩৯। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট বিদ্যুৎ বিল ১ হাজার ২৫ টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ১ হাজার ২৭৮ টাকা আর অক্টোবর মাসে বিল এসেছে ১ হাজার ৪৭৭ টাকা। রিকশা চালক স্বামীসহ তিন সদস্যের সংসার তার। ঘরে একটা ফ্রিজ, রাইস কুকার, ফ্যান আর লাইট রয়েছে তার। মিটার দেখতে কেউ না আসলেও প্রায় প্রতি মাসেই তাকে বিল দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো।

এই গৃহিনী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ বলেই তো আমরা আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছি। এরপরও আমাদের গুণতে হচ্ছে ভুতুরে ওই বিদ্যুৎ বিলের টাকা। এতো টাকা পরিশোধ করতে চরম কষ্ট হয়। 

আশ্রয়কেন্দ্রের অপর বাসিন্দা আন্না খাতুন বলেন, ‘যারা ব্যাটারি চালিত ভ্যানসহ নানা ধরণের জিনিস চার্জ দিচ্ছেন, তাদের বিদ্যুৎ বিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আসে। আমি ঘরে একটা ফ্যান আর বাতি ব্যবহার করি তাতেই প্রতিমাসে বিল আসছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। গরিব মানুষ বলেই তো আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকি। টাকা থাকলে এখানে থাকতাম না। প্রতিটি জিনিসের দাম এখন বেশি এরপর এভাবে বিদ্যুৎ বিল আসলে তা পরিশোধ করতে খুব কষ্ট করতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ অফিসে বাড়তি বিলের বিষয়ে জানানো হলেও তারা বলেন বিল যা আসবে তাই দিতে হবে। আমরা গরিব মানুষ হওয়ায় তারা আমাদের কথা শোনেন না।’

গৃহিনী রাহেলা খাতুন বলেন, ‘একটা ফ্রিজ, ফ্যান আর লাইট ব্যবহার করি। তাতেই বিদ্যুৎ বিল আসছে ১ হাজার ৫০০ টাকার মতো। এই মাসে ১ হাজার ৪৭৭ টাকা বিল এসেছে। আমরা এতো টাকা বিল দিলে খামু কি। এছাড়াও বাথরুমগুলোতে ময়লা জমে গেছে। ওই ময়লা ফেলার কোনো জায়গা না থাকায় চরম কষ্টে আছি। এছাড়াও ঘরগুলো তৈরিতে রয়েছে অনেক সমস্যা। হাত দিয়ে চিমটি দিলে খসে পরছে ঘরের প্লাস্টার। ড্রেনের ব্যবস্থাসহ চলাচলের রাস্তা না থাকায় বেশি কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে।’

আইয়ুব আলী বলেন, এক বছর হলো এই আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছি। বেশ কয়েকদিন যাবৎ পানির ট্যাংকির সমস্যায় আছি। পানি ব্যবহার করতে পারছি না। টানা বৃষ্টির কারণে ট্যাংকির নিচের মাটি সরে যাওয়ায় ট্যাংকিতে পানি উঠানো যাচ্ছে না। এ কারণে ট্যাংকির পানি ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। ট্যাংকির পানিতেও রয়েছে আয়রন। এরপরও ট্যাংকির পানি সরবরাহ ঠিক থাকলে আমাদের পানির সমস্যা অনেকটা লাঘব হবে।’

আশ্রয়কেন্দ্রে এক বছর ধরে বসবাসকারী ঝর্না বেগম বলেন, ‘থাকার জমি ছিল না প্রধানমন্ত্রী থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখানে আমরা ভালো আছি। পরিবারের সবজি খাওয়ার যোগান দিতে বাড়তি জমিতে লাউ আর বটবটি আবাদ করছি। কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো সমাধান করে দিলে আমাদের সুবিধাই হবে।’

দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চিলাবাড়ী গ্রামের ইউপি সদস্য শহীদ সরকার বলেন, ‘ড্রেন, যাতায়াতের সড়ক না থাকাসহ টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন উঠায় চরম সমস্যায় রয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা। তারা আমার কাছে অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্বে আছেন উপজেলা প্রশাসন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এই গ্রামে টিউবওয়েলের জন্য ৬০ ফুট পাইপ গাড়লেই ভালো পানি পাওয়া যেত। সেখানে টিউবওয়েলের পাইপ গাড়া হয়েছে ২০০ ফুট। এ কারণে ওই পানিতে আয়রন উঠছে।’

টাঙ্গাইল বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ- ২ এর নির্বাহী প্রকৌশল মো. সাহাগির হোসেন বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েকটি ডিজিটাল মিটার রয়েছে। এছাড়া বেশির ভাগই প্রিপেইড মিটার। ডিজিটাল মিটারে ভুতুরে বিল বা গড় বিল করার সুযোগ নেই। এছাড়াও কেউ আমাকে কোনো অভিযোগ দেননি। এরপরও যদি কোনো ভুক্তভোগী থেকে থাকেন, তিনি অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রের যাতায়াতের সড়ক, জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যার কথা শিকার করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রানুয়ারা খাতুন বলেন, ‘নদী সংলগ্নে আশ্রয়কেন্দ্র গুলোর ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চিলাবাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশে কোনো নদী বা খাল না থাকায় ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা নিরসন সম্ভব হয়নি। তবে সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা রয়েছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। টিউবওয়েলের পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন থাকায় ওই পানি ব্যবহার করতে সমস্যা হচ্ছে এমন অভিযোগ পেয়েই জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তবে কেন এখনও পানির সমস্যা নিরসন করা হয়নি বিষয়টি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারবো। দ্রুতই পানির সমস্যা সমাধান করা হবে।’ 

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইবনে মায়াজ প্রামানিক বলেন, ‘পানিতে পর্যাপ্ত আয়রন রয়েছে। পানি ব্যবহার উপযোগী করতে আশ্রয়কেন্দ্রের টিউবওয়েলে ফিল্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুতই কার্যক্রম শুরু করা হবে।’

মাসুদ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়