মেসিকে পরানো হয় বেস্ত: বগুড়া থেকেও রফতানি হয় এই রাজকীয় পোশাক
এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম
বেস্ত তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা
বগুড়ায় তৈরি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজকীয় পোশাক ‘বেস্ত’। তৈরি করছে ‘বেস্ত আল নূর’ নামের প্রতিষ্ঠান। প্রতি মাসে ৫০টির মতো ‘বেস্ত’ তৈরি হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। যেগুলো রফতানি করা হয় সৌদি আরব, কাতার, আবুধাবি, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে। সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় মেসির গায়ে এই রাজকীয় পোশাক পরিয়ে দেন শেখ তামিম।
এরপরই ‘বেস্ত আল নূর এন্টারপ্রাইজের’ স্বত্বাধিকারী নূর আলমের জামাতা রবিউল ইসলাম, যিনি কাতারের দোহায় থাকেন, তিনি তার ফেসবুকে পোস্ট দেন, ‘তাদের তৈরি পোশাক মেসির গায়ে’। এরপর মিডিয়ায় ‘বেস্ত আল নূর’ প্রতিষ্ঠানটি আলোচনায় আসে। তবে মেসির গায়ে যে ‘বেস্ত’ পরিয়ে দেওয়া হয়, সেটি বগুড়ার কি-না এটা এখনও নিশ্চিত করেনি ফিফা কর্তৃপক্ষ।
প্রতিষ্ঠানটির স্বস্তাধিকারী নূর আলম জানিয়েছেন, মেসিকে যে বেস্ত পরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটি তার প্রতিষ্ঠানের তৈরি না।
‘বেস্ত আল নূর’ এর মালিক নূর আলম ১৯৮০ সালে প্রথম সৌদি আরব যান। সেখানে বিশেষ ধরনের এই পোশাক তৈরি কারখানায় থেকে কাজ শিখে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এর কয়েক বছর পর তিনি কাতার যান। সেখানে বেস্ত তৈরির কাজ করতেন। এরপর দেশে ফিরে তিনি ২০১৩ সালে তার নিজ গ্রাম বগুড়া সদরের হাঁপুনিয়ায় কয়েকজন পুরুষ শ্রমিককে কাজ শিখিয়ে ‘বেস্ত’ তৈরি শুরু করেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘বেস্ত আল নূর এন্টারপ্রাইজ’। এরপর সৌদি আরব, কাতার, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ‘বেস্ত’ রফতানি শুরু করেন। প্রতিটি বেস্ত ধরন অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি করা হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন নারী ও পুরুষ কাজ করছেন।
প্রতিষ্ঠানের বেস্ত তৈরির কারিগর শামীম রহমান বলেন, তারা সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করেন। একটি বেস্ত তৈরি করতে ৭ দিন সময় লাগে। একটি পূর্ণ ‘বেস্ত’ তৈরি হতে ছয়টি ধাপ পার করতে হয়। ধাপগুলো হলো বাতানা, হেলা, তোঘতাসরিফ, বুরুজ, মাকসার, বরদাখ ও সিলালা। প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা কারিগর রয়েছে। কেউ হেলার কাজ করেন। কেউ করেন তোঘতাসফি। এভাবে সবগুলো ধাপ শেষে পূর্ণাঙ্গ বেস্ত তৈরি হয়।
শামীম আরও বলেন, তিনি আর মানিক নামের আরেক ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানের মালিক নূর আলম প্রথম বেস্ত তৈরির কাজ শেখান। এরপর তারা অন্যান্য আরও কয়েকজনকে কাজ শেখান। তারা প্রত্যেকে মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা উপার্জন করেন। তিনি মূলত ‘বুরুজের’ কাজ করেন।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক নূর আলম বলেন, দেশে ফিরে বেস্ত তৈরি করবেন এবং সেগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি করবেন— এমন পরিকল্পনা নিয়ে তিনি দেশে ফেরেন। সেই সময় তিনি পোশাকটি তৈরির কাঁচামাল সঙ্গে করে আনেন। এরপর তিনি ২০১৩ সালে এলাকার কয়েকজন যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে বেস্ত তৈরি শেখান। এতে তার অনেক সময় লেগেছে। কারখানাটি করতে তার অনেক পরিশ্রম হয়েছে। ১০-১২ জন কারিগর তৈরি হওয়ার পর তিনি অল্প করে পোশাক তৈরির পর সেগুলো বিক্রি করতেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে বড় করেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশে তার তৈরি পোশাক রফতানি হচ্ছে। সৌদি আরব এবং কাতারে থাকার সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তিনি পণ্য রফতানির বাজার তৈরি করতে পেরেছেন। মাসে তার কারখানায় ৪৫ থেকে ৫০টি বেস্ত তৈরি হয়। ধরনের উপর নির্ভর করে বেস্তর দাম ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় পাইকারি বিক্রি হয়। প্রতি পিস বানানো থেকে শুরু করে রফতানি পর্যন্ত খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মতো। একেকটি বেস্ত থেকে তার লাভ থাকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এতে মাসে তিনি সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ করতে পারেন দেড় থেকে ২ লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে তাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষ করে পোশাকটি তৈরির সমস্ত কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। মালগুলো নিয়ে আসতে ঝামেলা হয়। তার ২৫ লাখ টাকার মতো মাল কাস্টমসে আটকে আছে। বৈধ কাগজপত্র সবই আছে। এরপরও অনেক চেষ্টা করেও মালগুলো নিয়ে আসতে পারছেন না। সরকার থেকেও সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
নূর আলম বলেন, ‘সরকার থেকে সহযোগিতা পেলে এই কর্মযজ্ঞ অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবো। কারণ আমাদের কাছে চাহিদা আছে অনেক। কিন্তু আমরা সেই অনুযায়ী মাল দিতে পারছি না।’
মেসিকে যে ‘বেস্ত’ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটি তার কারখানার কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসলে এটা বগুড়ার তৈরি এটা কেউ বলতে পারবে না। কারণ কাতারেও অনেক কোম্পানি আছে।সেখানে এই পোশাক তৈরি হয়। যেটা শোনা যাচ্ছে, এটা গুজব। আমরাও ও রকম বেস্ত বানাই। আমাদের বেস্ত সবখানে সেল হয়। তবে কাতারে কম যায়।’
/বকুল/