হাটবাজারে ভেজাল গুড়, ওজনেও কারসাজি
সুদীপ্ত শামীম, গাইবান্ধা সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
শীত এলেই গ্রামগঞ্জে হরেক রকম পিঠা আর ক্ষীর খেয়ে রসনার তৃপ্তি মেটানো বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। নতুন চালের আটা আর আখের গুড় দিয়ে গ্রামগঞ্জের বৌ-ঝিয়েরা বাড়িতেই বানিয়ে ফেলেন ভাপা, চিতই, দুধ চিতই, তেলে ভাজা, পাটি সাপটা, সিদ্ধ কুলি, নকশী নারিকেল পিঠাসহ হরেক রকম পিঠা।
বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন কিংবা পরিবারের সদস্যদের তৃপ্তি মেটাতে গুড়ের তৈরি পিঠা আর ক্ষীরের জুড়ি মেলা ভার। পিঠা তৈরির অন্যতম উপাদানই হলো গুড়। কিন্তু ভেজাল গুড়ে সয়লাব এখন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার। পিঠা তৈরির অন্যতম এই উপাদানটি কিনতে গিয়ে কোনটা আসল আর কোনটা নকল তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন ভোক্তারা। এছাড়াও রয়েছে ওজনে কারসাজির অভিযোগ।
সরেজমিনে পৌর বাজার ও মীরগঞ্জ বাজার ঘুরে দেখা যায়, সহজ সরল ভোক্তারা কিনছেন ক্ষীর, পিঠা, মোয়া তৈরি কিংবা চিড়া ও মুড়ি দিয়ে খাওয়ার জন্য গুড়। সবাই আসল গুড়ের সন্ধান করছেন বাজারে। তবে গুড় ব্যবসায়ীরা অনেকগুলো গুড়ের মধ্য থেকে গুড়ের মুঠা ভোক্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দাম চাইছেন ৯০ টাকা। আসল গুড় চাইলে অন্য আরেকটি মুঠা দেখিয়ে দিয়ে বলছেন এটার দাম ১০০ টাকা।
একই গুড় দামে কম-বেশি কেন? ভোক্তারা জানতে চাইলে দোকানিরা বলছেন, ভালো-মন্দ বলে দামেও কম-বেশি হয়। সচরাচর মুঠা হিসাবে গুড় বিক্রি হওয়ায় ওজনও পরখ করে দেখার প্রয়োজনবোধও করেন না ভোক্তারা। ভোক্তাদের এমন সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে ঠকিয়ে চলছেন গুড় ব্যবসায়ীরা।
দোকানিদের ভাষ্য, প্রতিটি মুঠা নাকি ষাটের ওজনে বিক্রি হয়। ষাটের ওজন! কেজিতে কতটুকু বলতেই তারা বলছেন, ৭৫০ গ্রাম।
ভোক্তার কেনা মুঠা দাঁড়িপাল্লায় দিয়ে দেখা গেল গুড় রয়েচে ৫৯৭ গ্রাম। ভোক্তা ডিজিটাল পরিমাপক যন্ত্রের সাহায্যে মুঠা পরিমাপ করতেই বেড়িয়ে এলো ওজন নিয়ে কারসাজির বিষয়টি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একেকটি মুঠার ওজন একেক রকম। কোনোটি ৫৭৭ গ্রাম, কোনোটি ৫৯০ গ্রাম, কোনোটি আবার ৫৯৯ গ্রাম। ওজনে কম কেন ভোক্তা জিজ্ঞেস করতেই দোকানি খুঁজে খুঁজে বের করলেন আরেকটি মুঠা, যার ওজন ৭৩৪ গ্রাম। ব্যবসায়ীদের ওজনে এমন কারসাজিতে ভোক্তাদের প্রতিটি মুঠায় ঠকানো হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম গুড়। যার বাজার দাম প্রায় ১৪-২১ টাকা।
নিতাই চন্দ্র সাহা নামের এক ভোক্তা বলেন, ‘আগে গুড়ের তৈরি যে ক্ষীর এবং পিঠা আমরা খেতাম তার স্বাদ ও গন্ধ যেন এখনো লেগেই আছে মুখে। কিন্তু ভেজাল গুড়ের জন্য এখন আর সেই স্বাদও নেই, নেই সেই গন্ধও।’
গুড়ে ভেজাল আর ওজনে কমের বিষয়ে জানতে চাইলেই দোকানিরা দেখিয়ে দিলেন বাজারে উপস্থিত গুড় তৈরিকারক মহাজনকে।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার মির্জাপুর থেকে আসা মহাজন নটকু চন্দ্র, চৈতা পাল সটকে পড়লেও কথা হয় একই এলাকার মাঞ্জু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মীরগঞ্জসহ সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন মুদি ব্যবসায়ী কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির জন্য ১০০ থেকে দেড়শ গ্রাম কম ওজনের গুড়ের মুঠা অর্ডার করে। আমরা কম ওজনের তৈরি করে দেই। চিনি বা কৃত্রিম চিনি মিশিয়ে তৈরিকৃত ভেজাল গুড় বিভিন্ন বাজার ও রাস্তার মোড়ের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করা হয়।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) রংপুর অঞ্চলের ঊর্ধ্বতন পরীক্ষক মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘গুড়ে কৃত্রিম রং মেশানো স্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর।’
বিএসটিআই রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মফিজ উদ্দিন আহমাদ বলেন, ‘গুড় ষাটের ওজনে নয় বিক্রি করতে হবে কেজি হিসাবে। ওজনে কারচুপি ও ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গাইবান্ধাতেও অভিযান চালানো হবে খুব তাড়াতাড়ি।
মাসুদ