‘হামরা তো শুধু নারী না, মানুষও’
সুদীপ্ত শামীম, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম
গাইবান্ধায় ৬৫ হাজার নারী সরাসরি কৃষিসহ অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত। ছবি: রাইজিংবিডি
গাইবান্ধা জেলায় ৬৫ হাজার নারী সরাসরি কৃষিসহ অন্যান্য পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবন নির্বাহ করে থাকেন। এদের মধ্যে জেলার ৭ উপজেলার ১৫৬টি ইটভাটা ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে অন্ততপক্ষে ১০ হাজার নারী সরাসরি সম্পৃক্ত। এসব নারীদের বেশির ভাগই অসচ্ছল, স্বামী নেই। পরিবারে অভাব-অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী হওয়ায় এসব নারী পরিবারের মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়াসহ সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয় বহন করতে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। শ্রমজীবী নারীরা পুরুষের সাথে সমতালে কাজ করলেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন মজুরিতে।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ
জানা যায়, দিন দিন নারী শ্রমিকদের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে লিঙ্গ বৈষম্য কমে আসলেও কায়িক শ্রমের ক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্য যেন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে এসব শ্রমজীবী নাারীদের ওপর। পুরুষ শ্রমিকরা প্রতিদিন যেখানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে মজুরি পাচ্ছেন কিন্তু পক্ষান্তরে একই কাজ করে নারী শ্রমিকরা পাচ্ছেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও বাড়ছে না তাদের মজুরি। ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব শ্রমজীবী নারী তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম ইউনিয়নের পূর্ব শান্তিরাম গ্রামের কৃষি শ্রমিক আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ‘জমিত কাম করলে দেয় আড়াইশ থাকি ৩০০ টেকা। বেটাছইলেরা (পুরুষরা) পায় হামার থাকি ডবল (দ্বিগুণ) টেকা। সবাই খালি হামাক ঠকায়। ওমার (তাদের) বুঝা উচিত। হামরা তো শুধু নারী না, মানুষও। কাম করলে পেটোত ভাত যায়, না করলে নাই।’
উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের নবাবগঞ্জ গ্রামের কৃষি শ্রমিক মজিরন বেওয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। স্বামী নাই। মানুষের জমিত কাম করি খাই। কিসের হামার দিবস-টিবস। কামলা না দিলে হামার পেটোত ভাত যায় না, হামরা এগলে দিবস (আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস) কি করি?’
সাঘাটার উপজেলার একটি ইটভাটার শ্রমিক আলেয়া বেওয়া বলেন, ‘পুরুষ শ্রমিকের সাথে কাজ করি অথচ মজুরি পাই অর্ধেক। এটা নিয়ে মালিকের সাথে কথা বলেও কাজ হয়নি। নারী হওয়ায় মজুরি বৈষম্যের শিকার।’
গাইবান্ধা শহরের নারী হোটেল শ্রমিক আমেনা বেগম বলেন, ‘পুরুষের সাথে একই ধরনের কাজ কাজে সমসময় ব্যয় করি অথচ আমাকে ১৩০ টাকা কম দেওয়া হয়। কাজটা হারানোর ভয়ে কোনদিন প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি।’
নারীরা বলছেন, নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমঅবদান রাখলেও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্য রয়েই যাচ্ছে। নারী হিসেবে দয়া বা করুণা নয়, অধিকার হিসেবে এই বৈষম্য দূর হবে এমনটাই আশা ভুক্তভোগী নারীদের।’
গাইবান্ধার নারী নেত্রী হাসিনা জোয়াদ্দার বলেন, ‘এখন নারীদের অধিকার আদায় শুধু দিবসের ওপর সীমাবদ্ধতা হয়ে পড়ছে। এই দিবসে নারীদের সাথে পুরুষদের সম্পৃক্ত করা বেশি প্রয়োজন। কারণ পুরুষেরাই বেশি বৈষম্য করেন। একটি প্রতিষ্ঠানের পুরুষ কর্মকর্তা বা মালিক যদি বিষয়টি নিজের দৃষ্টি দিয়ে সঠিক বিবেচনা না করেন তাহলে এই বৈষম্য দূর করতে আরও সময় লাগবে।’
গাইবান্ধা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সহ-সভাপতি নওশের আলম নারীদের শ্রমবৈষম্যের কথা স্বীকার করে বলেন, নারীরা পুরুষের সমান কাজ করলেও ব্যবসায়িক কারণে সুযোগ নিয়ে শ্রমমূল্য কম দেওয়া হয়। তবে, আকাশ-পাতাল বৈষম্য মোটেই ঠিক না। পুরুষের চেয়ে সামান্য কম মজুরি দেওয়া হয়।’
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার জয়া প্রসাদ বলেন, ‘নারী পুরুষের বৈষম্য এখনও আছে। নারীদের কম শ্রমের জন্য এক ধরনের প্রতিষ্ঠান মালিকেরা সুযোগ নেয়। এ ধরনের বৈষম্য দূর করতে সিডিও সনদ অনুযায়ী কাজ করা দরকার।’
/সুদীপ্ত/সাইফ/