ঢাকা     শুক্রবার   ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২৮ ১৪৩১

ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ: ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগের দাবি

মেহেদী হাসান শিয়াম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৭, ৮ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৭:০০, ৮ এপ্রিল ২০২৩
ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদ: ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগের দাবি

প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনা মসজিদ

‘মসজিদের পাশ দিয়েই সরকারি রাস্তা, খানিক দূরেই স্থলবন্দর। সারাক্ষণ ভারী ট্রাক যাতায়াত করে। অনান্য ছোটবড় গাড়ির কথা বাদই দিলাম। এতো জোরে ট্রাক যাতায়াত করে, মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে। পুরাতন মসজিদ কোনো কিছু ভেঙে মাথায় পড়ে কি-না আতঙ্কও লাগে। এই আশঙ্কা নিয়েই আমাদের এখানে নামাজ পড়ি।’

সাংবাদিক পরিচয়ে ঐতিহাসিক ‘ছোট সোনা মসজিদের’ হালহকিকত জানতে চাইলে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের বালিয়াদিঘি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক।

প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনা মসজিদ। এই মসজিদের গা ঘেঁষে প্রতি মুহূর্তেই চলেছে ভারী-ট্রাকসহ অসংখ্য যানবাহন। যার ফলে কেঁপে ওঠে প্রাচীন এই মসজিদটি। 

আরো পড়ুন:

সুলতানি আমলের স্থাপত্য চাঁপাইনববাগঞ্জের সীমান্তবর্তী শিবগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর মৌজার ছোট সোনা মসজিদটির অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য রক্ষার দাবি স্থানীয়দের। শিগগির এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে প্রাচীন আমলের এই মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ সোনা মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণ

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা শিবগঞ্জে স্থাপিত ছোট সোনা মসজিদটি সুলতানি আমলের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে শিল্প ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন। মসজিদের গম্বুজগুলোর মধ্যস্থলে কেন্দ্রীয় গম্বুজ হিসেবে দেশের প্রচলিত চৌচালা বাড়ির চালের মতো পরস্পর তিনটি গম্বুজ রয়েছে। সব মিলিয়ে এই মসজিদটিতে রয়েছে মোট ১৫টি গম্বুজ। যা সোনা মসজিদের অপরূপ শোভা ধারণ করেছে। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে নারীদের নামাজ পড়ার জন্য একটি স্বতন্ত্র ছাদ রয়েছে। সেখানে যাতায়তের জন্য উত্তর দেওয়ালে একটি সিঁড়িও রয়েছে। 

সিঁড়ি সংলগ্ন একটি মিনারও রয়েছে আজান দেওয়ার জন্য মসজিদটিতে। নিপুন কারুকার্য খচিত মেহরাব রয়েছে এই মসজিদে।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৮২ ও প্রস্থ ৫২ ফুট, উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মসজিদের চারপাশে অষ্টকোণ বিশিষ্ট সুউচ্চ চারটি বুরুজ আছে। মসজিদটিতে নামাজ পড়ার জন্য মোট তিন সারি (কাতার) রয়েছে। মসজিদে ঢোকার জন্য সামনের দেওয়ালে সমমাপের পাঁচটি দরজা রয়েছে। মসজিদটি মূলত ইটের ইমারত হলেও দেওয়ালের বাইরের অংশ পাথর দিয়ে আবৃত। পাথরের উপর খোদায় করা লতাপাতা, গোলাপ ফুল, ঝুলন্ত শিকল, ঘণ্টার কারুকার্য তো আছেই।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, কিছু সংখ্যক স্বর্ণশিল্পী এই মসজিদের সাজ-সজ্জার পরিকল্পনা বা নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। পরে এ গম্বুজগুলো সোনালী রঙে গিল্ট (সোনায় বাঁধানো) করা হলে এটি সোনা মসজিদ নামে পরিচিতি পায়। স্থানীয় লোকেরা গৌড়ের বড় সোনা মসজিদের সঙ্গে তুলনা করে একে ‘ছোট সোনা মসজিদ’ বলেও ডাকতেন বলে জানা গেছে। 

মসজিদের ভেতরের অপরূপ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সবাইকে

বঙ্গের গৌরবময় রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আলা-উদ-দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ, আরবি সাল- ৮৯৯-৯২৫ হিজরি) ওয়ালী মুহম্মদ আলী এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদের দরজার ওপরের অংশের একটি পাথরে খচিত উৎকীর্ণ আরবী শিলালিপি থেকে এই তথ্য জানা যায়। কিন্তু ওই শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলি মুছে যাওয়ায় নির্মাণকাল জানা যায়নি। এই মসজিদের প্রাচীর সীমানার মধ্যে সমাহিত রয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

আনুমানিক ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালের বহুলাংশ ভেঙে পড়ে। ১৯০০ সালে ইট দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অংশ মেরামত করা হয়। বাইরে থেকে মসজিদটির পশ্চিম দিকের দেওয়ালটি দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়, দেয়ালটি সংস্কার করা হয়েছে। 

ঐতিহাসিক ছোট সোনা মসজিদের ইমাম মাওলনা মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ বলেন, ‘এই মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও সপ্তাহে জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও বছরে দুই ঈদের জামাত হয়। পাশেই আছে সোনা মসজিদ স্থলবন্দর, ওই বন্দর থেকে আসা ভারী যানবাহন যাতায়াত করে। যানবাহন চলাচলের কারণে মসজিদটিতে তীব্র কম্পন অনুভূত হয়। যারা মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তে আসেন, তারা এই বিষয়টা মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যারা অন্য জেলা থেকে এই মসজিদটি দেখতে আসেন, মসজিদে নামাজ পড়েন তাদের কিছুটা হলেও ভয় লাগে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মসজিদটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এমন ভাবে চলতে থাকলে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রাচীন এই মসজিদটি রক্ষায় বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা প্রয়োজন।’ 

২০০৯ সালের মার্চ মাসে ছোট সোনা মসজিদটি রক্ষায় বাইপাস সড়ক নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পের ওপর ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৩ সালের ২৩ মে সড়ক ও জনপথ ও পরিকল্পনা কমিশনের যৌথ প্রতিনিধি দল সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করে। কিন্তু গত ১০ বছরেও প্রস্তাবিত গুরুত্বপূণ এই প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মসজিদটির দেওয়াল ইট দিয়ে সংস্কার করা হয়

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সানজিদা আফরীন ঝিনুক বলেন, ‘পূর্বের বাইপাস সড়ক নির্মাণ কাজ করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিলো কি-না বলেতে পারবো না। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনা মসজিদ পর্যন্ত সড়কটি প্রশস্ত করণের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এই প্রকল্পটি। এ মহাসড়কটি ৬ দশমিক ৩ মিটার থেকে ১০ দশমিক ৩ মিটারে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা।’

সড়কটির কারণে সোনা মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সড়ক প্রশস্ত করণ প্রস্তাবটিতে সোনা মসজিদ রক্ষার কথাও বলা হয়েছে। এই মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের কারণে যেন প্রাচীন এই মসজিদটির কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য ব্যারিয়ার দেওয়া হবে। এতে মসজিদ থেকে যে কম্পন অনুভূত হয়, সেটা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে আমরা আশাবাদী।’

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়