‘পাঠান’ দেখতে দলবেঁধে বগুড়ার সিনেপ্লেক্সে দর্শকরা
এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম
বাংলাদেশের সিনেমা হল মালিকদের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিলো হিন্দি সিনেমা আমদানির। অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর চলতি মাসের ১২ তারিখ থেকে বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সসহ দেশের ৩৮টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ইয়াশ রাজ ফিল্মসের মুভি ‘পাঠান।’ বিশ্বব্যাপী আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তির অনেক পর বাংলাদেশে সিনেমাটি মুক্তি পেলেও বলিউড বাদশা শাহরুখ খান আর দীপিকা পাডুকোনদের বড় পর্দায় দেখতে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে ভিড় করছেন সিনেমাপ্রেমীরা। এর ব্যত্যয় ঘটেনি বগুড়াতেও।
মুক্তির প্রথম দিন বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সের সবগুলো শো’ই ছিলো প্রায় হাউজ ফুল। মুক্তির পঞ্চম দিনেও বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিবার নিয়ে দলবেঁধে সিনেপ্লেক্সে আসছেন সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা। এইসব দর্শকদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা ইতোমধ্যে ‘পাঠান’ ইন্টারনেটে দেখেছেন। তবে বড় পর্দায় মুভিটি দেখার আগ্রহ থেকে সিনেপ্লেক্সে আসছেন তারা।
এদিকে, ব্যবসা ভালো করতে পেরে হল মালিকরাও আগামীতে ব্যবসার সুদিন দেখছেন।
সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা থেকে মধুসূদন দাস নামে এক ব্যক্তি পরিবার নিয়ে মধুবন সিনেপ্লেক্সে পাঠান দেখতে এসেছেন। তিনি জানান, শেষ কবে তিনি হলে সিনেমা দেখেছেন তা তার মনে নেই। তবে পাঠান সিনেমা মুক্তি পেয়েছে জানার পর পরিবার নিয়ে এসেছি সিনেমা দেখতে। সিনেমা হলের পরিবেশও তার কাছে খুব ভালো লেগেছে। অনেক উৎফুল্ল তিনি।
নাসিব নামে আরেক দর্শক জানান, তিনি সিনেমাটি ইন্টারনেটে দেখেছেন। তবে প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় শাহরুখ-দীপিকা পাডুকোনদের দেখার সুযোগ তিনি মিস করতে চাননি। কারণ শাহরুখ খানের আলাদা একটা ক্রেজ আছে এবং শাহরুখের প্রতি তার একটি ভালোবাস আছে। যে কারণে বন্ধুদের সঙ্গে করে সিনেপ্লেক্সে এসে সিনেমাটি দেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, এর আগেও তিনি হাওয়া এবং পরান সিনেমা হলে এসেই দেখেছেন। সিনেমা ভালো হলে বন্ধু-বান্ধব মিলে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখেন।
সুইটি এবং মিষ্টি দুই বোন জানালেন, তারা শাহরুখের ভক্ত। যেহেতু সিনেমাটি এসেছে তাই বড় পর্দায় দেখার সুযোগ মিস করতে চাননি তারা। তাই তারা হলে চলে এসেছেন।
বগুড়ার আবৃত্তি শিল্পী শ্রাবণী বলেন, সিনেমাটি তিনি অনলাইনে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন জানলেন সিনেমাটি বাংলাদেশে মুক্তি পাবে সে কারণে তিনি দেখেননি। আর একটি আগ্রহ থেকে তিনি এসেছেন সেটি হলো তিনি ২৬ বছর আগে সর্বশেষ সিনেমা হলে ঢুকেছেন তারপর আর ঢোকা হয়নি। তিনি তার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এতদিন পর সিনেমা হলে ঢুকে একটু এক্সাইটেড তিনি।
তিনি বলেন, এই ২৬ বছরে অবশ্যই বাংলাদেশী অনেক ভালো সিনেমা এসেছে। কিন্তু ব্যস্ততা এবং হলের পরিবেশের কথা চিন্তা করে আসা হয়নি। তবে সিনেপ্লেক্সের পরিবেশটা খুব ভালো লেগেছে। ভালো সিনেমা আসলে তিনি ভবিষ্যতেও হলে আসবেন।
বগুড়ার তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা সুপিন বর্মন বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ইতিবাচক চিন্তা করে থাকি। পাঠান সিনেমা দেশে মুক্তি পাওয়ায় আমি আনন্দিত। কারণ, আমি আমার শহরের সিনেপ্লেক্সে বসে শুধু হিন্দি নয়, সব দেশের সিনেমাই দেখতে চাই।
তিনি বলেন, গ্লোবালাইজেশনের এই সময়ে এসে যে বাধা হিন্দি বা অন্য দেশের সিনেমা চালানো যাবে না, চালালে বাংলাদেশের নির্মাতা কিংবা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা একেবারেই ভুল ধারণা। কারণ, আমি মনে করি, ভালো কন্টেন্ট নির্মাণ করে, সৃষ্টিশীলতা দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব। সুতরাং এখন পাঠান আসছে, ভবিষ্যতে আরো আসুক। অন্য দেশের সিনেমাও আসুক। আমরা ছোট স্ক্রিনে চলচ্চিত্র দেখতে চাই না, আমরা সিনেপ্লেক্সে সব দেশের সিনেমাই দেখতে চাই।
মধুবন সিনেপ্লেক্সের স্বত্ত্বাধিকারী আরএম ইউনুস রুবেল বলেন, হাওয়া সিনেমা চালানোর পর থেকে আমাদের কোন ব্যবসা হয়নি। গত ৭ মাস যাবৎ আমরা লোকসানে ছিলাম। কারণ হল চলুক আর না চলুক মাসে ৩ লাখ টাকা আমার ফিক্সড ব্যয় হয় হল পরিচালনা করতে গিয়ে। গত মার্চ মাস থেকে সিনেমা হল মালিকরা অপেক্ষা করছিলেন ‘পাঠান’ আসলে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার। কিন্তু মুক্তির দিন পেছাতে পেছাতে ছবিটাকে কিল করে দেওয়া হয়েছে। এরপরেও আমরা দর্শকদের যে সাড়া পাচ্ছি এতে আমরা কিছুটা রিকভার করতে পারছি। ঈদে যে ছবিগুলো মুক্তি পেয়েছে এর মধ্যে তিনটা ছবি মোটামুটি ব্যবসা সফল ছিলো। আর কোনো ছবিতেই কেউ ব্যবসা করতে পারেনি। পাঠান সিনেমায় আমাদের এভারেজ সেলের মধ্যে যাচ্ছে। হলে কিন্তু নতুন নতুন দর্শক দেখা যাচ্ছে। যারা হলে সিনেমা দেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন তারাও হলে আবার ব্যাক করছেন। এই যে হলে দর্শকদের ফিরে আসা এটা কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য।
তিনি আরো বলেন, ‘পাঠান’ দিয়ে একটা জিনিস পরিষ্কার হলো, সিনেমা হলকে সংস্কার করতে হবে। ভালো সিনেমা হল পেলে আর এ ধরণের সিনেমা পেলে দর্শক হবে। সেটা বাংলাদেশের শাকিব খান নিয়ে কোন ভালো সিনেমা বানালেও হবে।
হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশের জন্য কেন জরুরি বলে মনে করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দর্শকদের হলে ফিরিয়ে আনতে হলে ভারতীয় হিন্দি সিনেমা দরকার আছে। পাশাপাশি যৌথ প্রযোজনার সিনেমা দরকার আছে। বাংলাদেশি সিনেমার মান উন্নত করার দরকার। কারণ দর্শকরা উন্নত মানের সিনেমা দেখতে চান। মানুষ যে বাংলা সিনেমা বর্জন করছে এটা কিন্তু বাংলা হিসেবে না। মান নেই এজন্য। পাঠান সিনেমাটি যে দর্শক হলে বসে দেখছে, এটি শুরুর পর কেউ তো আর শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠতে চাইবে না। ছবির দৃশ্য, এডিটিং এসব উন্নত থাকতে হবে। মানুষ তো টাকা খরচ করে ৩ ঘণ্টা আনন্দ করবে এটাই চায়।
তিনি বলেন, বর্তমানে যেভাবে দর্শক আসছে এরকম দর্শক হলে তিনি ১০০ সিটের আরো একটি স্ক্রিন করবেন। এরফলে একই সঙ্গে তিনি বাংলা, হিন্দি এবং ইংলিশ সবগুলোকেই ডেট দিতে পারবেন। প্রথম দিনের শো আর আজকের শো দিয়ে তুলনা করা যাবে না। কারণ পাঠান ৪ মাস আগে রিলিজ হয়েছে। মানুষ মোবাইলে, ওটিটি প্লাটফর্মে ছবিটি দেখে ফেলেছে। এরপরেও যে দর্শক হচ্ছে আমরা খুবই আশাবাদী মানুষ বড় পর্দায় হিন্দি সিনেমা দেখবে। সিনেমাটি যদি ভারতের মুক্তির দিনই বাংলাদেশেও মুক্তি পেত তাহলে আমরা ব্যবসা আরো ভালো করতে পারতাম। আমরা আমদানিকারককে সব সময় বলে আসছি, ভারতের সঙ্গে মিলে একসঙ্গে ছবি রিলিজ করার জন্য। এটা করলে যে ইনকামটা আসবে তাতে হল মালিকদেরও পোষাবে এবং আমদানিতে লগ্নির টাকাটা উঠিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। আর যদি এরকম দেরিতে রিলিজ করলে বেসিক্যালি আমরা কম পাচ্ছি দর্শক।
মাসুদ