ফুল গ্রেইন চালে সুদিন ফিরছে হাস্কিং মিলের
মঈনুদ্দীন তালুকদার হিমেল, ঠাকুরগাঁও || রাইজিংবিডি.কম
![ফুল গ্রেইন চালে সুদিন ফিরছে হাস্কিং মিলের ফুল গ্রেইন চালে সুদিন ফিরছে হাস্কিং মিলের](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2023August/rice-2308160517.jpg)
দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বন্ধের উপক্রম হওয়া হাস্কিং মিলগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে
অটো রাইস মিলের দৌড়াত্ম্যে দেশব্যাপী হাস্কিং মিলগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এমন সময়ে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে আশার আলো দেখাচ্ছে ফুল গ্রেইন চাল। দিন দিন এ চালের চাহিদা বাড়ছে। স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে ফুল গ্রেইন চাল। ফলে, সুদিন ফিরছে মিলারদের। এর পাশাপাশি বাড়ছে কর্মসংস্থান।
খাদ্য অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী মো. শামীম সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুলাই মাসে ঠাকুরগাঁও জেলায় লাইসেন্সধারী হাস্কিং মিল ছিল ১ হাজার ৭৬৯টি এবং অটো রাইস মিল ছিল ২৩টি। চলিত বছরের জুলাই পর্যন্ত জেলায় লাইসেন্সধারী হাস্কিং মিলের সংখ্যা ৮৮৯টি এবং অটো মিল চালু আছে ১৮টি। তবে, পরবর্তী বছরগুলোতে হাস্কিং মিল আর কমবে না বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
হাস্কিং মিলের এই ক্রান্তিলগ্নে মিল মালিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব ব্যাংক ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ও পিকেএসএফ’র সহযোগিতায় ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের বাস্তবায়নাধীন উপ-প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)।
এই প্রকল্পের আওয়তায় হাস্কিং মিলগুলোতে পরিবেশবান্ধব চিমনি স্থাপন, পরিবেশদূষণ কমানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ফুল গ্রেইন চাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে, তেমনই দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচ উপজেলায় বন্ধের উপক্রম হওয়া মিলগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
আগে মিলগুলোর চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়াসহ ছাই ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশের ক্ষতি হতো। এখন পরিবেশসম্মতভাবে নতুন পদ্ধতিতে চিমনি স্থাপন করায় পরিবেশদূষণ কমেছে। মিলের অন্যান্য ক্ষেত্রেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে।
নতুনভাবে সাজানো হাস্কিং মিলগুলোতে শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজ করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থাসহ পোশাক পরিচ্ছদ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট রাখা হয়েছে। তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনা এড়াতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, অসুস্থতায় প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধপত্রের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
শ্রমিকরা বলছেন, অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় মিলগুলোতে কাজ করা বেশ সহজ হয়েছে। আগের মতো আর কষ্ট করতে হয় না। রোদ হলে একেকটি মিলে দুই দিনের ব্যবধানে পুষ্টি ও ভিটামিনসমৃদ্ধ প্রায় ২০০ বস্তা চাল উৎপাদন করা হয়।
মেসার্স আবুল কাশেম হাস্কিং মিলে কর্মরত ঝড়ি বেগম নামের এক শ্রমিক বলেন, আগে যে মিলগুলোতে আমরা কাজ করতাম, সেগুলোতে টয়লেটের ববস্থা থাকত না। সেজন্য আমাদের সমস্যা হতো। এখন শুধু টয়লেটের ব্যবস্থা নয়, আমাদের জন্য নিরাপদ পানি, পোশাকসহ ওষুধের ব্যবস্থাও আছে। তাই, কাজ করতে আগের মতো আর কষ্ট হয় না।
মিলের ম্যানেজার হারুনুর রশিদ বলেন, রোদ হলে একেকটি মিলে মাত্র দুই দিনে প্রায় ২০০ বস্তা পুষ্টি ও ভিটামিনসমৃদ্ধ চাল উৎপাদন করা যায়। এসব চালের মধ্যে ফুল গ্রেইন, গাঞ্জিয়া, বিআর-২৮, বিআর-২৯, বিআর-৮৪ ও জিংক চাল প্রস্তুত করা হয়। পুষ্টিসমৃদ্ধ ফুল গ্রেইন চাল বেশ সুস্বাদু। ভোক্তা পর্যায়ে এর চাহিদা বাড়ছে। তাই, এ চাল নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরের হাস্কিং মিলগুলোর মালিকরা।
মিল মালিক আবু সালেহ জানান, অটোরাইস মিলের কারণে একসময় হাস্কিং মিলগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন ইএসডিও’র সহযোগিতায় পুষ্টিসমৃদ্ধ ফুল গ্রেইন চাল উৎপাদন করে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন। এসব চালের চাহিদা থাকায় লাভবান হচ্ছেন তারা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও বেশি করে উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
মেসার্স আবুল কাশেম হাস্কিং মিলের মালিক মো. আবুল কাশেম বলেন, ইএসডিও’র সহয়োগিতায় আমরা পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করছি। এসব চাল উৎপাদন করে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি ও লাভের মুখ দেখছি। চাহিদা থাকায় আমাদের হাস্কিং মিলে উৎপাদিত চাল স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। অটো মিলের চালের তুলনায় হাস্কিং মিলে উৎপাদিত চাল পুষ্টি ও মানে বেশি ভালো হওয়ায় ভোক্তারা ঝুঁকছেন এ চালের দিকে।
মন্দির পাড়ার বাসিন্দা রাসেল ইসলাম বলেন, অটো মিলের চালে তেমন স্বাদ পাওয়া যায় না। সে তুলনায় ফুল গ্রেইন চালের ভাত বেশ সুস্বাদু। শুনেছি, এই চালগুলো বেশ পুষ্টিসমৃদ্ধ। তাই, আমার বাসায় ফুল গ্রেইন চালের ভাত খাওয়া শুরু করেছি।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যমে একদিকে মানুষের যেমন স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশসম্মত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনই শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানেরও সুযোগ বাড়ছে। এর সুফল সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আগমীতে শুধু ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলায় নয়, এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
ইএসডিও’র এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁও খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা খন্দকার আবুল বাসার। তিনি বলেন, ‘ফুল গ্রেইন চাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এতে যেমন পরিবেশদূষণ রোধ হবে, তেমনই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যও নিশ্চিত হবে। আমরা চাই, সব হাস্কিং মিল এ প্রকল্পের আওতায় আসুক।
/রফিক/
আরো পড়ুন