ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, কিংবদন্তি রাজনীতিকের বিদায় 

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ২৮ আগস্ট ২০২৩  
অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, কিংবদন্তি রাজনীতিকের বিদায় 

অধ্যক্ষ মতিউর রহমান

ময়মনসিংহের কিংবদন্তি রাজনীতিক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের (৮১) মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শত শত নেতাকর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও সব শ্রেণিপেশার মানুষ হাসপাতালে ভিড় জমান।

রোববার (২৭ আগস্ট) রাত পৌনে ১১টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর ধোপাখোলা নেক্সাস কার্ডিয়াক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক জানিয়েছেন।

বর্ষীয়ান এ নেতার মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠানসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা।

বর্ষিয়ান এই রাজনীতিককে একনজর দেখতে সোমবার (২৮ আগস্ট) সকালে মরদেহ আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে হাজারো নেতাকর্মী, ভক্ত ও শ্রেণিপেশার মানুষ ভিড় জমান। এ সময় শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও সব শ্রেণিপেশার মানুষ। 

বিকেলে শীববাড়িস্থ দলীয় কার্যালয়ে মরদেহ আনা হলে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলী প্রদান করেন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। এরপর মরদেহ নেওয়া হয় আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দানে। সেখানে গার্ড অব অনার শেষে জানাজায় হাজারও মানুষ শরিক হন। জানাজায় ঐতিহাসিক আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে চর্তুদিকে রাস্তায়ও ভিড় জমে। 

জানাজাপূর্ব বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাংস্কৃতিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদ, সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু, সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেন, শফিউল আলম নাদেল, স্বেচ্ছাসেবকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু, ময়মনসিংহ গফরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল ও অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ছেলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত। জানাজায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নেতাকর্মীরা অংশ নেন। 

মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) নগরীর আকুয়া মড়লবাড়ি এলাকায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে মরদেহ দাফন করা হবে বলে জানান তার পরিবার।

শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন- জাতীয় সংসদের হুইপ আতিকুর রহমান আতিক, আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন এমপি, মনিরা সুলতানা মনি এমপি, সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু, বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া, ডিআইজি দেবদাস ভট্রাচার্য, জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজার রহমান, পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞাঁ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, সাবেক সভাপতি জহিরুল হক খোকা, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক একেএম শফিকুল ইসলাম, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক অমিত রায়, সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আতাউল করিম খোকন ও সাধারণ সম্পাদক মীর গোলাম মোস্তফা, রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম, কমিউিনিস্ট পার্টির সভাপতি এমদাদুল হক মিল্লাত, জেলা জাসদের যুগ্ম-সম্পাদক নজরুল ইসলাম চুন্নু প্রমুখ। 

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
প্রবীণ সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ১৯৪২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৃত আবদুর রেজ্জাক এবং মাতা মৃত মেহেরুন্নেসা খাতুন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে এম.এস.সি. সম্পন্ন করার পর প্রথমে জামালপুর জেলার নান্দিনা কলেজ এবং পরে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। পড়াশুনার পাশাপাশি ছাত্র জীবনে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেন। তিনি অভিনয়, নাটক, আবৃত্তিসহ নানা প্রকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন।

১৯৫৮ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সাংগঠনিক জীবনে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান দুই বার ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দ্বিতীয়বার ও বর্তমানে আওয়ামী রীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে মতিউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ১৪৯ (ময়মনসিংহ-৪) আসন থেকে ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তিনি জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নবম সংসদে তিনি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ি কমিটি’র সভাপতি, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’র সম্মানিত সদস্য, জাতীয় সার সমন্বয় ও বিতরণ কমিটি’র সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বাধীনতার পর থেকে তিনবার ময়মনসিংহ পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

রাজনৈতিক কারণে তিনি বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ করেছেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সন পর্যন্ত দুই মেয়াদে দীর্ঘ ২৩ মাস কারাবরণ করেন। তিনি ২০০২ সালে ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলার মিথ্যা মামলায় কারাবরণ করেন। শত প্রলোভনের মুখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি অবিচল থেকে তিনি তার সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অকৃত্রিম অবদানের জন্য অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ‘মুজিব দর্শন বাস্তবায়ন পরিষদ’ কর্তৃক ২০০০ সালে ‘বঙ্গবন্ধু পদক’ লাভ করেন।

অধ্যক্ষ মতিউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক ও সফল সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ঢালু যুব শিবিরের ইনচার্জ ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে তার নেতৃত্বে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। তার নেতৃত্বেই ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ হানাদার মুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান রণাঙ্গন ছেড়ে দেশ গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন।

মতিউর রহমান বৃহত্তর ময়মনসিংহে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ জানুয়ারি গণআন্দোলনে শাহাদাত বরণকারী আলমগীর মনসুর মিন্টুর নামে ১৯৬৯ সালে তিনি আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৪ বছর তিনি এ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মেহের রাজ্জাক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠা করেন বাসাবাড়ি মার্কেট ও গাঙ্গিনাপাড় হকার্স মার্কেট। তিনি নাসিরাবাদ গার্লস স্কুল, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ এবং নওমহল সানফ্লাওয়ার প্রি-ক্যাডেট স্কুল প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়াও একাধিক মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করে। ১২ জানুয়ারি তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে গঠিত মহাজোট সরকারে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। 
 

মিলন/বকুল 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়