ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

গাইবান্ধার চরের প্রাথমিক শিক্ষা

মেঝে-খুঁটিতে থেমে গেছে বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ

মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ৩০ আগস্ট ২০২৩   আপডেট: ২২:০২, ৩০ আগস্ট ২০২৩
মেঝে-খুঁটিতে থেমে গেছে বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ

খঞ্চাপাড়া শুক্কুর আলী (ফিরোজ) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

প্রতিবছর বন্যা এলে নদীগর্ভে বিলীন হয় গাইবান্ধা জেলার চরাঞ্চলের অনেক স্কুল। আর নির্মাণ কাজ শেষ না করেই গা-ঢাকা দিচ্ছেন ঠিকাদাররা। এ সব কারণে প্রতি বছর পাঠদান ব্যাহত হয় চরাঞ্চলের সহস্রাধিক শিশু শিক্ষার্থীর। চরাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার সরকারের প্রচেষ্টা সফল হচ্ছে না কিছু কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলায়।

জেলার ফুলছড়ি উপজেলার বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ ও হস্তান্তর নিয়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। বিদ্যালয়গুলোর  ভবন নির্মাণ শেষ না করায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বেলাল হোসেন।

গত ১০ জুলাই ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বেলাল হোসেন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ তথ্য জানা গেছে। ওই প্রতিবেদনে (স্মারক নং- উশিঅ/ফুল/গাই/৭৭৪/২) প্রাপক হিসেবে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দেখানো হয়েছে।

সেখানে বলা হয়েছে, নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে না পারায় ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্মাণ কাজ বন্ধ করা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগ এবং ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। 

এই প্রতিবেদকের হাতে আসা আরেকটি চিঠিতে জানা যায়, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি  স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর হতে পাঠানো এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মজিবুর রহমান সিকদার স্বাক্ষরিত শোকজের চিঠিতে সেই সময়ে দায়িত্বরত তিন প্রকৌশলীর কর্তব্য কাজে অদক্ষতা, অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় এর কারণ জানতে চেয়েছে। সেই  চিঠিতে ১৫ জানুয়ারি হতে পরবর্তী সাত দিনের (২১ জানুয়ারি) মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে। অভিযুক্ত তিন প্রকৌশলী হলেন, সাবেক ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলী ইমতিয়াজ আহমেদ ইমু, সহকারী প্রকৌশলী মাহাবুবা রোজী, সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ।

                                                         খঞ্চাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

ফুলছড়ি উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল রফিকুল ইসলাম গত ২২ আগস্ট রাইজিংবিডি-কে বলেন, ‘ছয় বিদ্যালয়ের কন্সট্রাকশন কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। এখন শুধু ফার্নিচার বাকি।’ 

গত ১০ আগস্ট ছয় জন প্রধান শিক্ষক তাদের বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ দ্রুত শুরু করার দাবি জানিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেখানে তারা কোনো বিদ্যালয়ের কাজ ২৫ শতাংশ, কোনোটির ৩০ শতাংশ কাজ করার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে প্রকৌশলী রফিকুল রফিকুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আপনি তাহলে আপডেটই জানেন না। অভিযুক্ত ছয়টি বিদ্যালয়ের কনসট্রাকশন কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। শুধু ফার্নিচার বাকি। ফার্নিচারের অর্ডার দিয়েছি। দিয়ে দিলেই আমরা দিব, এই'! আর যা বলছি, এটাই সত্য।’ 

একই দিন এই ছয় বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে মুঠোফোনে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন জেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটির আংশিক কাজ বাকি আছে। বাকি পাঁচটির কাজ শেষ হয়েছে। আমাকে তো ছবি পাঠিয়েছে। আপনি যান, দেখে আসেন।’

সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া গেল বক্তব্যের একেবারে ভিন্নচিত্র। প্রধান শিক্ষকদের করা অভিযোগের তালিকা অনুযায়ী প্রথম যাওয়া হয় খঞ্চাপাড়া শুক্কুর আলী (ফিরোজ) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় নীরব পরিবেশ। পুরাতন টিনের জরাজীর্ণ ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ৫ ফিট উচ্চতার দুটি ইটের প্রাচীর (শ্যাওলায় আবৃত)। পাশে একটি জঙ্গলে ভরা খেঁজুর গাছকে ঘিরে আছে আরেকটি সম উচ্চতার দেয়াল। ভবন নির্মাণ না হওয়ায় স্থানীয়রা সেখানে পাট শুকানোর কাজ করছেন।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন শীল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘২১ সালের কাজ, এখন ২৪ সাল এসে গেল। তিন বছর থেকে ঠিকাদারদের ফোন করলে বলেন, আজ করছি, কাল করছি, ওই পর্যন্তই। এতদিনেও কেন স্কুলের কাজ শুরু হচ্ছে না, আমি প্রকৌশলী এবং ঠিকাদারের কাছে এটা জানতে চাই।’ 

পূর্ব খোলাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবন। এই ভবনের সামনের ফাঁকা জায়গায় নতুন ভবন নির্মাণের স্থান নির্ধারিত

কিছু দুরেই অভিযুক্ত আরেকটি বিদ্যালয় খঞ্চাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকমাস আগে বিদ্যালয়টির মেঝে নির্মাণ এবং চারিপাশে লোহার খুঁটি লাগানো হয়েছে। সেখানে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আব্দুর রউফ খোকন। আপনার বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ নাকি শতভাগ শেষ হয়েছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘স্কুলের কাজ শেষ করার কোনো মানষিকতাই নেই ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার কারও মধ্যে। একবার কেউ খোঁজ পর্যন্ত নিতে আসে না। সরকার কত দিন আগে, সেই ২১/২২ অর্থবছরে টাকা দিয়েছে বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য। কিন্তু দেখেন কী হাল হয়েছে?’

খঞ্চাপাড়া চর থেকে সরদারের চর বেশ দূরে। সেখানকার সরদারের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যালয়গুলোর একটি। ১৯১৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটিও খঞ্চাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো। শুধু মেঝে আর চারিপাশে খঁটি। সেগুলোও অনেক দিন আগে করা হয়েছে বলে জানালেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক স্বপন ঘোষ।

অভিযুক্ত আরেকটি বিদ্যালয়ের নাম পশ্চিম খাটিয়ামারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিউল আলম বলেন, ‘আপনার নিউজ করার পর আগের ইঞ্জিনিয়ার নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়ের অসমাপ্ত কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত শুধু টিনের বেড়া আর কিছু দরজা, জানালা লাগাচ্ছেন। কিন্তু সেগুলো পুরনো ও নড়বড়ে। তাই মাপ মিলছে না। টিন, দরজা, জানালা সব ছোট বা বড়।’ 

আরেকটি বিদ্যালয় পূর্ব খোলাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানকার প্রধান শিক্ষক রাজু আহমেদ। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে যোগাযোগ করেন রাইজিংবিডির এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ এসেছে অনেক আগেই। কিছু দিন আগে ঠিকাদার এসে শুধু বিদ্যালয়ের জায়গার মাপ নিয়ে গেছে। ওই মাপ নেওয়া পর্যন্তই। এ পর্যন্ত ভবন নির্মাণের কোনো সামগ্রীই আসেনি।’ 

সরেজমিনে পূর্ব খোলাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে দেখা হয় ফুলছড়ি উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমানের সঙ্গে। তিনিও বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসেছিলেন। এ বিষয়ে রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করছি। দেখলাম কিছু বিদ্যালয়ে শুধু অবকাঠামোর কাজ হয়েছে, তবুও আংশিক। এটা ধরে নেওয়া যায় ১০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো। বাকিগুলোতে চাল, বেড়া কিছুই লাগানো হয়নি। এই বিদ্যালয়গুলো সঠিক সময়ে নির্মাণ করা হলে শিক্ষার্থীরা যেমন উপকৃত হতো, তেমনি সরকারের চরের মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচেষ্টা সফল হতো। আমরা ইতোমধ্যে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছি।’ 

                                                            সরদারের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

এ ব্যাপারে ফুলছড়ি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বেলাল হোসেন বলেন, এ সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে সংশ্লিষ্ট ঠিকদাররা ব্যর্থ হয়েছেন। সেই অনুযায়ী ছয়টি বিদ্যালয়ের কাজ বন্ধসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।

ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিসুর রহমান এ অবস্থাকে দুঃখজনক ও সুচতুর কারবার আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।’

এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হারুনর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি ছুটিতে আছেন।

জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার আল ইমরান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কাজ না করেই বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া ঠিক নয়। আমার ক্ষমতা সীমিত। স্যার (জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা) যোগদান করলে তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’ 

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়