ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

থাকছে না ‘ফুড ভিলেজ প্লাস’, আর বাস থামবে না 

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২০:৫৬, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
থাকছে না ‘ফুড ভিলেজ প্লাস’, আর বাস থামবে না 

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় অবস্থিত এস আর গ্রুপের ‘ফুড ভিলেজ প্লাস’ নামে উত্তরাঞ্চলের ২২টি জেলার মানুষের পরিচিত হোটেল বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে হোটেলটির মালিক বগুড়া সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছেন।

মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের হাটিকুমরুলে অবস্থিত ফুড ভিলেজ প্লাসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) সাগর আহম্মেদ এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের জন্য মালিকপক্ষ এই হোটেলটি স্থানীয়ভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। সেটি ভেঙে ফেলা হবে। এখানে আর কোনো গাড়ি থামবে না।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় গড়ে ওঠেছিল ফুড ভিলেজ হোটেলটি। বর্তমানে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের চার লেনের কাজ চলছে। একই সঙ্গে হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কাজও চলছে। একারণে ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলটি বন্ধ করে দিয়েছে মালিক। দিন-রাত হোটেলটি চালু থাকায় গড়ে ওঠেছিল চা-পান-সিগারেটের ৫০টিরও বেশি ছোট-বড় দোকান। হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় এই ব্যবসায়ীরা কোথায় যাবেন তা জানেন না তারা। এ ছাড়াও এখন দূরপাপ্লার এই বাসগুলো কোথায় যাত্রা বিরতি দেবে এমন প্রশ্নও রয়ে গেছে। হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন ঢাকা-পাবনা রুটে চলাচলকারী যাত্রীরা।

এস আর গ্রুপের হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট ফুড ভিলেজ প্লাস সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেল উদ্বোধন করেন এস আর গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। সেদিন থেকে যাত্রা শুরু হয়ে প্রায় ১০ বছর পর করে বন্ধ হয়ে গেল হোটেলটি।

হোটেলের সামনে পান-সিগারেট বিক্রি করা আলা উদ্দিন, শফিকুল ও রফিকুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, এখানে রাত-দিন উত্তরবঙ্গের সব জেলার গাড়িগুলো দাঁড়াত। এই যাত্রীরা হোটেলের সামনের দোকান থেকে পান, সিগারেট, চিপস, পানীয় কেনাকাটা করতেন। এই হাজার হাজার মানুষের কাছে পণ্য বেচে চলত তাদের জীবিকা। এখন হোটেল বন্ধ হয়ে গেল। এখানে আর বাসও দাঁড়াবে না। তাই এখানে আর ব্যবসা করার সুযোগ নেই। জানি না কোথায় গিয়ে নতুন করে আবার ব্যবসা শুরু করবেন। হোটেল বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে তারা।

ফুড ভিলেজ প্লাসে কাজ করা জাহিদুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক বলেন, ফুড ভিলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হোটেলের বিভিন্ন পদে প্রায় ৬০০ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়লো। এখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বারবিকিউ, চাইনিজ, বাবুর্চি, ওয়েটার ও সহকারীসহ প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করতেন। হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় সবাই কর্মহীন হয়ে পড়বেন। তবে হোটেল বন্ধ হয়ে গেলেও শ্রমিকেরা এখন পর্যন্ত বেতন পায়নি। বেতন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে মালিকপক্ষ।

শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার এরশাদ আলী বলেন, এখন থেকে ১৬ মাইল এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের সব বাস হোটেল হানিফে দাঁড়াবে। তাদের হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় হোটেল থাকলেও সেটি আপাতত বন্ধ আছে। তবে হাটিকুরুল গোলচত্বর এলাকায় দাঁড়ানো বাসগুলো ধরে রাখতে তারা আপাতত ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্প শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সেটি পুনরায় চালু করবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

নওগাঁ বাস মালিক সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কের উন্নয়ন কাজের জন্য ফুড ভিলেজ হোটেলটি বন্ধ হয়েছে। এ কারণে আমার যে নিজস্ব পরিবহন আছে এসপি ট্রাভেল, সেটা অলরেডি ফুড গার্ডেন নামে আরেকটি হোটেলের সঙ্গে কথা বলে সেখানে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব গাড়ির মালিক পক্ষই এখন অন্য কোনো হোটেলের সঙ্গে কথা বলে সেখানে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করছে। আলোচনা সাপেক্ষে দ্রুতই গাড়িগুলো মহাসড়কের বিভিন্ন হোটেলে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করবে।

তিনি আরও বলেন, হোটেলটি বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়েছেন ঢাকা থেকে পাবনাগামী যাত্রীরা। পাবনার পরে হাটিকমুরুল গোলচত্বর হয়ে আলেঙ্গার আগে কোনো উন্নত মানের হোটেল নেই। বাসগুলো কোথায় যাত্রাবিরতি দেবে তা নিয়ে এখন পর্যন্ত বলতে পারছেন না তারা। তবে পাবনা ও নওগাঁর বাস মালিক সমিতির নেতারা দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেবে। 

হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদরুল কবীর বলেন, রাজশাহী ও বগুড়াগামী রোডে খুব ভালো হোটেল না থাকলেও কিছু হোটেল আছে। কিন্তু পাবনা রোডে যাত্রাবিরতি দেওয়ার মতো হোটেল নেই। হয় এলেঙ্গা বিরতি দিতে হবে, না হলে একদম পাবনা গিয়ে। তবে এটা শিশু ও বয়স্কযাত্রীদের জন্য কষ্টকর হবে। 

পাবনা বাস মালিক সমিতির অফিস সচিব আমিনুল ইসলাম বাবলু বলেন, হোটেল বন্ধ হওয়ায় বাসগুলো এখন কোথায় দাঁড়াবে সেটা নিয়ে চিন্তায় আছেন মালিক পক্ষ। যেমন যাত্রীদের জন্য সমস্যা, তেমনই সমস্যা হলো বাস মালিকদেরও। তবে তিনি আশা করেন, দ্রুতই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চলে আসব।

ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলের সিনিয়র উপমহাব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান রেজা সাগর বলেন, দীর্ঘ ১০ বছর সুনামের সঙ্গে সেবা দেওয়ার পর বর্তমানে ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে হোটেলটি বন্ধ করে দিতে হলো। এই হোটেলটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছিল। এখন হাটিকুরুল এলাকায় আর দূরপাল্লার ভালো বাসগুলোর যাত্রাবিরতি দেওয়ার তেমন জায়গাও থাকল না। ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেল কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগা ও বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলার বাস যাত্রাবিরতি দিত। এখন তারা আর এখানে বিরতি দেবে না। আর সেই পরিচিত ড্রাইভার ও সুপার ভাইজারদের সঙ্গে কথাও হবে না। 

শাহজাহান রেজা সাগর আরও বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত অন্য কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তেমন কোন জায়গাও পাওয়া যায়নি। বিষয়গুলো নিয়ে সাসেক প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা নলকা ব্রিজের আশপাশে ভালো কোন জায়গার খোঁজ-খবর নিচ্ছি। জায়গা পেলে সেখানে চলে যেতে পারি। এখন পর্যন্ত আমাদের এমনই চিন্তাভাবনা রয়েছে।’ 

হাটিকুমরুল এলাকার নিউ-টাউন হাট-বাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘ফুড ভিলেজ হওয়ার আগে জায়গা পতিত ছিল। সেখানে পতিত জায়গার পাশাপাশি ছোটখাটো বিভিন্ন খানাখন্দও ছিল। শুনেছি ওই জায়গা সরকারি ছিল। তবে হোটেল মালিক ওই জায়গা লিজ নেওয়ার পরে সেখানে হোটেল তৈরি করেছিলেন।’ 

সাসেক-২ এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহবুব রাসেল বলেন, ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে হোটেলের জায়গা সরকার অধিগ্রহণ করেছে। তারপরও তারা (হোটেল কর্তৃপক্ষ) যেতে যাচ্ছিল না। তাদের অনেক বুঝিয়ে রাজি করা হয়েছে। পরে তারা হোটেল বন্ধ করে দিয়েছেন। আগামী ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে হোটেল ভাঙা শুরু হবে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হোটেলের ২ দশমিক ৬৭ একর জায়গা ২০১৩ ও ২০১৮ সালে দুই মেয়াদে ৫ বছর করে মোট ১০ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালে লিজ মূল্য ছিল ২ কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪০ টাকা। তবে ঢাকা অফিস থেকে তারা লিজ নেওয়ায় আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারছি না।’
 

/বকুল/ 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়