ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৪ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২০ ১৪৩১

নামজারি করতে ঘুষ বেঁধে দিলেন নাজিরপুরের এসিল্যান্ড! 

পিরোজপুর প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৮:৩৪, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
নামজারি করতে ঘুষ বেঁধে দিলেন নাজিরপুরের এসিল্যান্ড! 

এসিল্যান্ড মো. মাসুদুর রহমান

‘প্রতিটি নামজারির কেসের জন্য ১৫ হাজার টাকা নেবেন। ১০ হাজার টাকা আমার আর ৫ হাজার আপনাদের’- এমনটাই দাবি করেছেন পিরোজপুরের নাজিরপুরে এসিল্যান্ড মো. মাসুদুর রহমান। এসিল্যান্ড কর্তৃক তহসিলদারদের ঘুষ গ্রহণের নির্দেশের এমন একটি অডিও ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। 

সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী ও উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের (তহসিলদার) নিয়ে একটি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে এসিল্যান্ড মো. মাসুদুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা যে পার কেসে ডিলিংস করেন, তা এনসিওর করার কোনও ওয়ে আছে?’ খোলামেলা কথা বলার জন্য এসিল্যান্ড তহসিলদারদের বলেন, ‘আপনাদের মতামত শুনি যে আপনারা কী চাচ্ছেন’। তিনি আরও বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার সাথে শাখারিকাঠী ইউনিয়ন তহসিলদার মো. শাখাওয়াত সাহেবের সাথে সব বিষয়ে কথা হয়েছে’। মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন তহশিলদার মো. সুজন বলেন, ‘দুই একরের বেশি জমি হলে তখন আমরা কত নেব’? শ্রীরামকাঠী ইউনিয়ন তহশিলদার পরিমল বলেন, ‘এটা স্যারের ওপর নির্ভর করে। আপনি যেভাবে বলবেন, সেভাবে আমরা নেব’। 

তখন সদর ইউনিয়নের তহসিলদার শাহজাহান কবির বলেন, ‘সকল কেসে যেমন ১ একর, ২ একর বা ৩ একর বাতার চেয়েও বেশি জমির ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। যেমন ৫ হাজার ছিল। সেখানে আপনি বললে ৪ হাজার টাকা নামিয়ে আনতে পারি। আপনি যেভাবে বলবেন স্যার’। তখন এসিল্যান্ড বলেন, ‘ধরেন আমি ৪ হাজার নির্ধারণ করে দিলাম। আপনারা কত ডিল করবেন?’ 

প্রথমে মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের তহসিলদার মো. সুজন বলেন, ‘এখানে যদি ৪ হাজার দেওয়া যায় তা হলে মোট সাড়ে ৫ হাজার হলে হয়। আমরা সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকার বেশি নেব না’। নাজিরপুর সদর ইউনিয়নের তহসিলদার শাহজাহান কবির বলেন, ‘এখানে ৪ হাজারসহ মোট ৬ হাজার টাকা হলে হয়’। তখন এসিল্যান্ড বলেন, ‘এ অর্থবছরের জন্য প্রতিটি নামজারি কেসের জন্য আমাকে ৪ হাজার, আপনারা ২ হাজার মোট ৬ হাজার নেবেন’ বলে চূড়ান্ত করে দেন। এর পর আবার এসিল্যান্ড বলেন, ‘একচুয়ালি (বাস্তবে) আপনারা কয় টাকা নিতে চান বলেন এবং সে তার দিক থেকে প্রস্তাব করেন। আমাকে ৪ হাজার করে দেন, আপনারা দেড় হাজার মোট সাড়ে ৫ হাজার করে দেন’। তখন শেখমাটিয়া ইউনিয়ন তহসিলদার মো. হাসান হাওলাদার বলেন, ‘স্যার এটা ৬ হাজার করা হোক’। 

এসিল্যান্ড ৬ হাজার টাকা করে প্রতিটি নামজারির জন্য চূড়ান্ত করে নির্দেশনা দেন এবং বলেন, ৬ হাজার টাকার উপরে যেন না নেওয়া হয়। ‘খ’ তফসিলের নামজারির কেসের জন্য এসিল্যান্ড বলেন, ‘‘আমাকে ‘ক’ তফসিলের প্রতিটি কেসের জন্য ১০ হাজার টাকা করে দেবেন আর আপনারা ৫ হাজার টাকা করে নেবেন। মোট ১৫ হাজার টাকা নেবেন’’। 

উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কোন জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে পুরনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নামে নামজারি করতে সরকারিভাবে এর ফি হিসেবে ১ হাজার ১৭০ টাকা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। 

উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিস তাদের চাহিদামত টাকা নিচ্ছেন। কিন্তু এবার এসিল্যান্ড কর্তৃক এমনভাবে সেই ঘুষের টাকার নির্ধারণ করে দেওয়ায় সেবাপ্রত্যাশীরা হয়রানি বেশি হবেন। 

জানা গেছে, পিরোজপুর-১ আসনে একেএমএ আউয়াল এমপি থাকাকালে নাজিরপুর উপজেলা ভূমি অফিসের পেছনে খাস জমির ওপর একটি দ্বিতল পাকা ভবন তৈরি করেন। গত ২০২০ সালের দিকে তা নিয়ে দুদকে মামলা দায়ের হলে উপজেলা ভূমি অফিস তা নিজেদের দখলে নেন। ওই ভবনসহ ৪টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সংস্কারের জন্য গত ৫ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৭ লাখ ১১ হাজার ৪ শত ৬৭ টাকার টেন্ডারের মাধ্যমে ওই কাজ পাওয়া ‘মেসার্স  আহনা ট্রেডিং করপোরেশন’ নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে করা এক আবেদনে জানা গেছে, এসিল্যান্ড ওই কাজ নিজে সুন্দরভাবে করার কথা বলে ঠিকাদারদের কাজ করতে দেননি। ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজের টাকা উঠিয়ে তিনি নিজের অ্যাকাউন্টে রাখেন। গত ২২ জুন তিনি ‘সিটি ব্যাংক’ পিরোজপুরের একটি শাখা থেকে উপজেলা ভূমি অফিসের দুই কর্মচারীর মাধ্যমে নিজ এলাকার একটি অ্যাকাউন্টে ৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা পাঠান। সরকারিভাবে জমির মিউটেশনের জন্য ই-নামজারি ব্যবস্থা থাকলেও সনাতনী পদ্ধতিতে মিউটেশন করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় ভূমি অফিসের মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগসহ সেবাপ্রত্যাশীরা হয়রানির শিকার হন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা ভূমি অফিসের এক কর্মচারী জানান, তিনি (এসিল্যান্ড) প্রায়ই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে অফিসের গাড়ি নিয়ে জেলার বাহিরে যান। গত বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় গেলে বিভাগীয় কমিশনারের নজরে আসে। এ নিয়ে তিনি ক্ষিপ্ত হন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) মো. মাসুদুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, তিনি একটি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় আছেন। বিষয়টি নিয়ে তাকে সাজানোভাবে জড়ানো হয়েছে। তিনি কোনও অপরাধ করেননি বলে দাবি করেন। 

অডিও কথোপকথনের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডাক্তার সঞ্জিব দাশ বলেন, অডিও’র কথোপকথন তিনি শুনেছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। 

উল্লেখ্য, মো. মাসুদুর রহমান গত ৮ জুন জেলার নাজিরপুরে এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মরত ছিলেন। 

তাওহিদুল/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়