ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

ইট-পাথরের যুগে বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩  
ইট-পাথরের যুগে বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি ঘর। একসময় জেলার রায়গঞ্জ, সলঙ্গা ও তাড়াশ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে মাটির তৈরি ঘরবাড়ি নজরে পড়লেও এখন এই ঘর নির্মাণে কারো তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে জেলার উপজেলাগুলোতে মাটির বদলে ইট পাথরে নির্মিত দালান জায়গা করে নিতে শুরু করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মাটির ঘরে বসবাস করতে শুরু করেন। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিলেন। এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে বাড়ির দেয়াল তৈরি করতেন তারা। ১২-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় অথবা টিনের ছাউনি দেওয়া হতো। শুধু একতলাই নয়, অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত তৈরী করা হতো মাটি ঘর। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের সময় লাগতো ৪৫ থেকে ৬০ দিন। মাটির তৈরি ঘরের দেয়ালে সৌখিন গৃহিণীরা বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে তাদের নিজ-নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। বর্তমানে ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য মাটির ঘর ভেঙ্গে ইট-পাথর, লোহা, সিমেন্টের মিশ্রনে বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর দিকে ঝুঁকছেন। যার যেমন সামর্থ্য তিনি সেইভাবে তৈরি করছেন ঝকঝকে সুন্দর বাড়ি। 

মাটির তৈরি ঘর এখন চোখে আর না পড়লেও এটা মানতে হবে যে, এই ঘরগুলো শীত বা গরমে থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক ছিল। মাটির ঘরে শীতের দিনে ঘর থাকে উষ্ণ আর গরমের দিনে শীতল। তাই মাটির ঘরকে গরিবের এসিও বলা হয়ে থাকে। ইট-পাথরের ভিরে এখন আর তেমন চোখে পড়ে না গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য। কারিগররাও এখন এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা এখন কৃষি জমিতে শ্রম বিক্রি করছেন। আবার কেউ কাজ না পেয়ে স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রিও করছেন।

তাড়াশ উপজেলার দেশীগ্রাম ইউনিয়নের আড়ঙ্গাইল গ্রামের সালাম মণ্ডল বলেন, মাটির তৈরি ঘর আরামদায়ক। দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানরাও একসময় পরিবার-পরিজন নিয়ে মাটির তৈরি বাড়িতে বসবাস করতেন। বৃষ্টি বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এসব ঘর অনেক বছর পর্যন্ত টিকে থাকতো।

একই গ্রামের রফিক শেখ বলেন, আমার ‌‌বাবার তৈরী মাটির ঘরে এখন পর্যন্ত পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। বর্তমানে মানুষ আধুনিক জীবন যাপনের ইচ্ছা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে সবাই মাটির ঘর ভেঙ্গে টিন আর ইটের পাকা বা সেমিপাকা ও বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহি মাটির ঘর এখন বিলুপ্ত হতে চলেছে।

রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের রূপাখাড়া গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, ‌প্রায় ৪৫ বছর আগে এই মাটির তৈরি বাড়ি নির্মাণ করেছিলাম। তখনকার সময় আমার খরচ হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার টাকা। আমাদের এই এলাকায় মাটির ঘর অনেক রয়েছে। বর্তমানে এই ধরনের ঘর তৈরি করতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়।

একই এলাকার মোস্তফা কামাল বলেন, রায়গঞ্জ-তাড়াশ উপজেলায় আজও অনেক মাটির ঘর রয়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা বাপ-দাদার তৈরি মাটির ঘর প্রতি বছর কিছুটা মাটি দিয়ে সংস্কার করে আজও বসবাস করছেন।

বাংলাদেশ তৃণমূল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি শিপন চন্দ্র শিং বলেন, অনেকের মতে, আদিবাসীদের আগমন সিরাজগঞ্জে অনাদিকালে। অতীতে বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলের তাড়াশ-রায়গঞ্জ ও সলঙ্গা এলাকায় ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে বসবাস করতো তারা। তারা মাটি, বাঁশ ও টিন সংগ্রহ করে নিজেরাই মাটির ঘর তৈরি করতেন। ঘর তৈরির কারিগরের কাজও করতেন। কিন্তু বর্তমানে মাটির তৈরি ঘরের চাহিদা না থাকা এবং তুলনামূলক খরচ বেশি হওয়ায় এবং অনেক করিগর পেশা পরিবর্তন করায় এখন আর আগের মতো মাটির বাড়ি তেমন একটা দেখা যায় না।

তিনি বলেন, একসময় সিরাজগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ মাটির ঘর ছিল। তখনকার চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় মাতব্বর এবং সম্পদশালী ধনী লোকেরাও মাটির ঘর নির্মাণ করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্যবাহি মাটির ঘর বিলুপ্ত হচ্ছে।

রায়গঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৃপ্তি কনা মণ্ডল বলেন, রায়গঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় এখনো মাটির ঘর দেখা যায়। অনেকেই সংস্কার করে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ঘরে আজও বসবাস করছেন।

তিনি আরও বলেন, মানুষের অর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে জীবন মানেরও অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এতে  হারিয়ে যেতে বসেছে চিরচেনা মাটির তৈরী ঘরের ঐতিহ্য।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়