ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

রেমাক্রীর ৩০০ পরিবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত

চাইমং মারমা, বান্দরবান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৯:৫০, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
রেমাক্রীর ৩০০ পরিবার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত

বান্দরবানে থানচি উপজেলার রেমাক্রী ইউনিয়নে রয়েছে নাফাখুম, আমিয়াখুম ও রেমাক্রী জলপ্রপাতের মত পর্যটন স্পট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বেশ পরিচিতিও রয়েছে এ এলাকার। তবে ভ্রমণকারীদের জন্য এলাকাটি অতি জনপ্রিয় হলেও এই ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসা ১৮টি পাড়ার ৩০০ পরিবার ও শিশুরা মৌলিক অধিকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নম্বর এই দুই ওয়ার্ডে গত ২০-৩০ বছরের মধ্যে মেনহাত ম্রো পাড়া , বুলু পাড়া, থাংকোয়াই ম্রো পাড়া, কোয়াংক্ষ্যং পাড়া, ইয়ং ডং ম্রোক্ষ্যং পাড়া, চন্দ্র মোহন ত্রিপুরা পাড়া, ক্লুং ম্রো পাড়া,  রুইওয়াই ম্রো পাড়া, কংকং ত্রিপুরা পাড়া, ইয়ং ক্লাং ম্রো পাড়া, মালুমগ্য  মংবাউ মারমা পাড়া, সূর্যমনি ত্রিপুরা পাড়া, লাই পুং পাড়া, ইয়াংবং পাড়া, মাংচাই পাড়া, বাচি অং পাড়া, মেথোয়াই পাড়া, মেনপ্রে ম্রো পাড়াসহ মোট ১৮টি পাড়া গড়ে উঠেছে। এসব পাড়ায় ৩০০ পরিবারের প্রায় ২ হাজারেরও বেশি ম্রো, ত্রিপুরা ও মারমা পরিবারদের বসবাস। এসব পরিবারে অন্তত এক তৃতীয়াংশের বেশি শিশু ও কিশোর রয়েছে। গত ২০ বছরে কোনো স্বাস্থ্য কর্মীরা পৌঁছাননি এই পাড়াগুলোতে। এমনকি এখানকার শিশুরা অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বা রোগ প্রতিরোধক টিকাও পায়নি। গড়ে ওঠেনি কোনো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে এইসব পাড়ার বাসিন্দারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

লইক্রি পাড়ার প্রধান মুই তং ম্রো জানান, প্রায় ২০ বছর আগে ২০ পরিবারের ১০০ জন সদস্য মিলে লইক্রি এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন। বর্তমানে ৩৭ পরিবারের প্রায় ২৫০ জনের বসবাস এই পাড়ায়। এই ২০ বছরের মধ্যে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী তাদের পাড়ায় আসেননি। গত ১৯ বছর কোনো বিদ্যালয়ও ছিল না তাদের পাড়ায়। স্বাস্থ্য কর্মী না আাসায় আজ পর্যন্ত কোনো শিশুই সরকারিভাবে দেওয়া ভিটামিন-এ ক্যাপসুল বা রোগ প্রতিরোধক টিকাও পায়নি।

তিনি আরও জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের বাস্তবায়নে লইক্রি পাড়ায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত  শিক্ষা কার্যক্রম চালু হলেও বাকি ১৭ পাড়ায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ওইসব পাড়ার শিশুরা।

রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ডলুঝিড়ি পাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান) চন্দ্র মোহন ত্রিপুরা ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড পান ঝিড়ি (কোয়াইং ক্ষ্যং) ম্রো পাড়ার কারবারি কাইং ওয়াই ম্রো জানান, ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড মিলে ১৮টি পাড়ায় প্রায় ২ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। আজ পর্যন্ত তাদের পাড়ায় কোনো চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য কর্মীরা আসেননি। ফলে পাড়ার শিশুরা টিকা, ভিটামিন-এ ক্যাপসুল পায়নি। এছাড়া গর্ভবতী মায়েরাও স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসকের পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনো স্কুল না থাকায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা।

রেমাক্রী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মান চং ম্রো জানান, এলাকাটি দুর্গম আর যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য কর্মীরা যেতে আগ্রহী হন না। যার কারণে ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার শিশুরা ভিটামিন-এ ক্যাপসুল ও টিকা পাচ্ছে না। আগামীতে এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে যাওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবেন বলেও জানান তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বান্দরবান কার্যালয় থেকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি ও ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইনে জেলার শতভাগ শিশুকে টিকা বা ভিটামিন-এ প্রদানের কথা বলা হলেও রেমাক্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুই শৈ থুই মারমা জানান, থানচি উপজেলার আয়তন ১০২০ বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্য রেমাক্রী ইউনিয়নের আয়তন ৪৯৭ বর্গকিলোমিটার যা রুমা-রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকেও আয়তনে বড়।

তিনি আরও জানান, ২০২২সালের জনশুমারি অনুসারে রেমাক্রী ইউনিয়নের জনসংখ্যা ৮ হাজার ৬০০ দেখানো হলেও ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যমতে, বর্তমানে এই ইউনিয়নে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। যার মধ্যে ইউনিয়নের ৬ নম্বর ও  ৯নম্বর ওয়ার্ডে ৩০০ পরিবারের প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস। এলাকাগুলো দুর্গম ও যোগাযোগের মাধ্যম একমাত্র নৌ-পথ হওয়ার কারণে ওই এলাকার বাসিন্দারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

বান্দরবান সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, সব জনগণের স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সদ্য যোগদানের কারণে এই এলাকার কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে জানা নেই। যতটুকু শুনেছি ওই এলাকাগুলো অনেক দুর্গম। তবুও সবার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে রেমাক্রির ৬ ও ৯  নম্বর ওয়ার্ডের দুর্গম  এলাকাগুলোতে অন্তত প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর একটি ক্রাশ প্রোগ্রামের (বিশেষ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম) মাধ্যমে সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল মান্নান জানান, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী যদি কেউ স্কুলের ৩০ শতক জায়গা দিতে রাজি থাকেন এবং নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করেন তাহলে দুর্গম রেমাক্রী ইউনিয়নের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনা হবে।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়