ঢাকা     শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ৭ ১৪৩১

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃতি-পরিবেশ হুমকির মুখে

মনোয়ার চৌধুরী, সুনামগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ৮ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ২১:০৪, ৮ অক্টোবর ২০২৩
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃতি-পরিবেশ হুমকির মুখে

দেশের বৃহত্তম জলমহালগুলোর অন্যতম টাঙ্গুয়ার হাওর। মিঠাপানি ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়।  বর্ষা মৌসুমে সেই পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি এ হাওরকে কখনো আকাশের মতো নীল, কখনও আয়নার মতো স্বচ্ছ করে তোলে। হাওরে দিগন্ত বিস্মৃত থই থই জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচ গাছ। যেন জলের ওপর ভাসছে অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার। আর জলের এই ঢেউয়ে ঢেউয়ে খেলা করে মন ভরিয়ে দেয় আগত পর্যটকদের।

টাঙ্গুয়ার হাওর মূলত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ছোট-বড় ১০৯টি বিল নিয়ে গঠিত। তবে প্রধান বিল রয়েছে ৫১টি। দুই উপজেলার ৪ ইউনিয়নের ১৮টি মৌজা মিলে হাওরের মোট আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে অসংখ্য খাল ও নালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর রূপ নেয় নীল সমুদ্রে। 

আরো পড়ুন:

স্বচ্ছ পানির নীল সমুদ্রের এমন রূপে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের স্থান হিসেবে দেশ-বিদেশে বেশ জনপ্রিয়। কয়েক বছর আগেও এই হাওরে ভ্রমণ ও রাত্রিযাপন ছিল অনেক দুঃসহ। কিন্তু তিন চার বছর ধরে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য ও অতিরিক্ত চাহিদার কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরে এসেছে পর্যটকবাহী শত শত বিলাসবহুল হাউসবোটসহ নানা আধুনিক ব্যবস্থাপনা। এতে দিন দিন বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যা। তবে পর্যটক ও পর্যটকবাহী নৌ শ্রমিকেরা হাওরে এসে মানছেন না পর্যটন নীতিমালা। অবাধে চলছে নিষিদ্ধ ইঞ্জিনচালিত নৌযান। উচ্চস্বরে বাজছে মাইক। আবার অনেক পর্যটকরা হাওরের গাছ উঠে লাফালাফি করছেন হাওরের পানিতে। এক সঙ্গে কয়েকজন পর্যটক হিজল করচ গাছে উঠে যাওয়ায় ভাঙছে গাছের ছোট ডালপালা। এছাড়াও পর্যটকদের আনা চিপস-বিস্কুট ইত্যাদি প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল, নানা ধরনের পলিথিনসহ প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে হাওরের পানিতে। এতে ধ্বংস হচ্ছে হাওরের পরিবেশ। পর্যটনের নামে অবাধে এমন দূষণ ঠেকাতে প্রশাসনের নজরদারি নেই বলে অভিযোগ করেছেন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’ নেতারা।

ঢাকা থেকে হাওরে ঘুরতে আসেন সালাহউদ্দিন। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, এখানে (টাঙ্গুয়ার হাওরে) পানিতে প্রচুর ময়লা, বোতল পরে আছে। খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। আমার মনে হয় জায়গায়-জায়গায় কিছু বিলবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হলে সবাই সতর্ক থাকবে। 

আরেক পর্যটক বলেন, ‘পরিবেশটা খুবই সুন্দর। প্রথম আসাতে আরও বেশি এক্সাইটেড লাগছে। আমার যেটা রিকুয়েস্ট (অনুরোধ), এখানে যারা ঘুরতে আসে, তারা ময়লা আবর্জনা যেভাবে ফেলে, আমরা একটু সচেতন হলে পানি সংরক্ষণ করা যাবে।’ 

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে বলে জানিয়েছেন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’ সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে কুদরত পাশা। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় জায়গা হচ্ছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। এটা আমাদের জন্য সুখবর হলেও দেশের ভিন্ন স্থানে থেকে যে সকল পর্যটকরা আসছেন, এই পর্যটকদের কারণে সেই ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের পানি আজ নীল থেকে অন্য এক রঙ ধারণ করেছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য পর্যটকদের কারণে ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে আমাদের নিলাদ্রীর যে পানি ছিল, সেই পানিও আজ দূষিত, নিলাদ্রীর পানিতে ভেসে উঠছে প্লাস্টিক বোতল ও মদের বোতল। আমরা বিশ্বাস করি, পর্যটকরা এসব এখানে ব্যবহার করবেন না। এসব ব্যবহৃত জিনিস তারা যদি নিজেদের কাছে রেখে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন। তাহলে আমাদের পর্যটনটা ভালো থাকবে। বিশেষ করে আমাদের সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন টাঙ্গুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি, পর্যটকরা সেই নীতিমালা মানছেন না, এবং প্রশাসন সেই বিষয়ে ভূমিকা নেই। আমরা আশা করব, আমাদের এই পর্যটন শিল্পকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে এবং টাঙ্গুয়ার হাওরকে তার জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন কঠোর নজরদারি করবে।’

যে কেউ হাওরের নীতিমালা অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুপ্রভাত চাকমা। তিনি বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরকেন্দ্রিক যে পর্যটন, এ বছর আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুরা বাংলাদেশে সাড়া জাগানো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যটন স্পটগুলো ঘুরার সময় অনেক পর্যটক এবং নৌকার মাঝিরা ময়লা আবর্জনা ফেলে থাকে, যেটি আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আমরা এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি, আমরা জেলা প্রশাসন থেকে পর্যটকবাহী নৌ-পরিবহরের জন্য নীতিমালা করেছি। এই নীতিমালাতে বলে দিয়েছি, ময়লা আবর্জনাগুলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবে এবং ময়লা আবর্জনাগুলো নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে তাহলে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’ 
 

/বকুল/

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়