ঢাকা     শনিবার   ২৯ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৫ ১৪৩১

খুলনার ‘কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থার’ দুর্নীতি

প্রাথমিকের ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর তালিকায় ৭ জনের স্থলে ১ হাজার ৮১১!

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৩, ১১ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ১৬:৫১, ১১ অক্টোবর ২০২৩
প্রাথমিকের ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর তালিকায় ৭ জনের স্থলে ১ হাজার ৮১১!

প্রাথমিকের ঝরেপড়া শিক্ষার্থী আছে মাত্র ৭ জন। কিন্তু দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৮১১ জন! এর বাইরে অধিকাংশ শিক্ষাকেন্দ্রের অস্তিত্ব না থাকা, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা না দেওয়া, অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভর্তি, ভুয়া স্বাক্ষর দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ; শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, শিক্ষকদের বেতন, ঘরভাড়া ও বোনাস নিতে অর্থ আদায়সহ অভিযোগের পাহাড় জমেছে ‘কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। 

অনিয়ম-দুর্নীতির এ চিত্র খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার। 

জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাথমিকের ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের কাগজে-কলমে দেখিয়ে শিক্ষাদানের নামে অর্থ লুটপাটের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে। এ ছাড়া, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি স্কুলে ৫২ প্রকার শিক্ষা উপকরণ দেওয়ার কথা থাকলেও শুধু নামমাত্র বই-খাতা, পেনসিল ও চক দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাকিগুলোও কাগজ-কলমে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা  হয়েছে।

এখানেই শেষ নয়, গোটা উপজেলায় দুর্নীতির পুরো ‘প্যাকেজ’ বাস্তবায়ন হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে। দুর্নীতির এ ‘পুকুর চুরির’ পর এখন প্রকল্পের মেয়াদ শেষে পুরো ‘ব্যবসা’ গুটিয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্তা-ব্যক্তিরা। 

প্রাথমিকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করার লক্ষে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে সরকার। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর অধীনে ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন প্রোগ্রাম’ নামে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের পাঠদানের লক্ষে ২০২০ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কর্মসূচি (পিইডিআর-৪) নামে শিক্ষাপ্রকল্পটি গ্রহণ করে। খুলনা মহানগর ও জেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় ‘আশ্রয় ফাউন্ডেশন’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। আর এ সংস্থার মাধ্যমে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্ব পায় ‘কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’। 

করোনার জন্য নির্ধারিত সময়ের পরে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি তারা  প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করে। শেষ হয় চলতি বছরের ৩০ জুন।

খুলনা জেলা উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার এডিপির অর্থায়নে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য জেলার দিঘলিয়ায় ৬০টি স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব পায় কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। কিন্তু ১৫ মাস মেয়াদী এই প্রকল্পের শুরুতেই ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। 

কেন্দ্র নির্মাণ, আসবাবপত্র ও উপকরণ সরবরাহের জন্য বহুল প্রচারিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করার কথা থাকলেও মানা হয়নি। শিক্ষার্থীদের উপকরণসামগ্রী ক্রয় না করে কাগজ-কলমে দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাৎ করেন কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থাটির পরিচালক বিউটি আক্তার। এ ছাড়াও, শিক্ষকদের বেতন-বোনাস, ঘরভাড়া ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন খাতের কাড়ি কাড়ি টাকা আত্মসাৎ করেছে এনজিওটি। 

শুরু থেকে ঘর ভাড়া বাদে মাত্র ৫ মাসের বেতন পেয়েছেন কোনও কোনও শিক্ষক। এ বিষয়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে বলেও জানা গেছে।

সূত্র জানায়, নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্নভাবে ঝরেপড়া ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের এসব স্কুলে ভর্তির কথা। কিন্তু ঝরেপড়া শিশুদের সংখ্যার হিসাবেও দেওয়া হয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রতিটি কেন্দ্রে ৩০ জন করে  হিসাবে দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৮১১। তার মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ৯৫৫ ও মেয়ে ৮৫৬ জন। 

এদিকে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দিঘলিয়া উপজেলায় ৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২ হাজার ৫৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৭ জন। তবে কালিয়া সমাজ উন্নয়ন  সংস্থাটির জরিপে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে কাগজ-কলমে  ১ হাজার ৮১১ জন ঝরেপড়া শিশু নির্বাচন করে।

অভিযোগে জানা যায়, দিঘলিয়া উপজেলায় ৬০টি কেন্দ্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমের মাধ্যমে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামের ওই এনজিও। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন করে শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে ফ্লোর ম্যাট, ফ্যান, টিউব লাইট, ড্রেস, পানির জার, স্টিলের ট্রাংক, সাইনবোর্ড, হাতলওয়ালা চেয়ার, বেঞ্চ, শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড, টিচিং এইডস এবং গেমসসহ ৫২ প্রকার উপকরণসামগ্রী দেওয়ার কথা থাকলেও নামমাত্র কয়েকটি ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের নামে সিংহ অর্থই লুটপাট করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, অধিকাংশ স্কুল করা হয়েছে ঘরের বারান্দায়, রান্না  ঘরে। এসব জায়গায় সাইনবোর্ড থাকলেও ক্লাস হয় না। আবার কিছু কিছু কেন্দ্রের শুধু নামসর্বস্ব সাইনবোর্ড থাকলেও নেই কোনও কার্যক্রম। কোনও স্কুলেই ৩০ জন শিক্ষার্থী নেই। কয়েকটি স্কুল চললেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭-৮ জন। তারাও  অন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের, মাদ্রাসা, জুট মিলের শ্রমিক ও কোচিং সেন্টারের। অডিটে গেলে লোক ভাড়ারও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ আছে, স্কুলঘর বাবদ প্রতি মাসে ১৫০০ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় এক হাজার। এ ছাড়া, ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ আছে এই প্রকল্পের পরিচালকের বিরুদ্ধে। 

উপজেলার ৩৫নং পদ্মবিলা ও মুসলিমডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় কোনও ঝরেপড়া শিক্ষার্থী ও স্কুল নেই। আমার স্কুলের ৫/৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কয়েকদিন ক্লাস করেছে। আমার কাছে স্বাক্ষরের জন্য এসেছিল, কিন্তু আমি দেয়নি।  

পদ্মবিলা ও মুসলিমডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুরসালিন বলে, আমি রুবা আপার ঝরেপড়া স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সপ্তাহে মাঝে মাঝে বিকেলে পড়াতেন। আর আমি স্কুলড্রেস, উপবৃত্তির টাকাসহ কিছুই পাইনি।

অভিযোগের বিষয়ে কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক বিউটি আক্তার বলেন, আমার দিঘলিয়ায় ৬০টি কেন্দ্রের শিক্ষকদের বেতন, ঘরভাড়া, উপবৃত্তিসহ সবই সরকার বহন করে। ওর সাথে আমার সম্পৃক্ততা নেই। সরকার থেকে জেলা প্রশাসককে দেয়, ওখান থেকে সরাসরি শিক্ষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। উপকরণসামগ্রী জেলা অফিস ভালই জানে। আমাদের কাছে যেভাবে পাঠায়, আমরা সেভাবে বণ্টন করি। আর যা দিয়েছে, তা শিক্ষকরা বুঝে নিয়ে কাগজে স্বাক্ষর করে দেন। শুধু দিঘলিয়া উপজেলায় নয়, সারাদেশে এ রকম হয়েছে।

অনিয়মের পক্ষে ‘সাফাই’ গেয়ে পাল্টা প্রশ্নের সুরে তিনি বলেন, সারাদেশে ঝরেপড়া যে শিক্ষার্থী আছে, তা দিয়ে কি কোনও স্কুল হয়? সরকার যখন চালাচ্ছে, তখন এ বিষয়ে তার কাছে প্রশ্ন না করে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন করতে বলেন তিনি। দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেন, ‘প্রকল্প তো শেষ, এখন জেনে কী করবেন। আবার শুরু হলে আপনাদের নিয়ে বসব।’

খুলনা জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর সহকারী পরিচালক কাজী সাইফুজ্জামান পলাশ বলেন, কালিয়া সমাজ উন্নয়ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। যদিও দিঘলিয়ায় স্কুলের মেয়াদ শেষ। 

তিনি খুলনায় সদ্য যোগদান করায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছেন না। তবে আবার শুরু হলে দেখবেন বলেও জানান।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়