ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

বগুড়ায় ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত 

এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৭, ১৪ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ১৯:৩৯, ১৪ অক্টোবর ২০২৩
বগুড়ায় ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত 

বগুড়া শহরে মাত্র ১০ ফুট দূরত্বে পাশাপাশি অবস্থান দুই ধর্মের পূণ্যস্থানের। একপাশে সুফি সাধক শাহ ফতেহ আলীর (র.) মাজার, অন্যপাশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কালী মন্দির। শহরের ফতেহ আলী বাজারের প্রবেশপথে দেখা মিলবে এ চিত্রের।

মাজারের সঙ্গে আছে মসজিদ। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য মসজিদের মাইকে আজান দেওয়া হয়। আর সন্ধ্যায় মন্দিরে বেজে ওঠে ঘণ্টা ও শঙ্খ ধ্বনি। মাগরিবের নামাজের পরপরই মন্দিরে শুরু হয় সন্ধ্যাপূজা। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে দুই ধর্মের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। অথচ কারো মধ্যে ন্যূনতম মতবিরোধ পর্যন্ত হয়নি। দুই ধর্মের এমন সহাবস্থান এবং মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির নজির বগুড়াকে দিয়েছে ধর্মীয় সম্প্রীতির শহরের মর্যাদা।

ইতিহাস বলছে, ১৬৮৩ সালে ভারতের আশকারায় জন্ম নেন শাহ সুফি ফতেহ আলী (র.)। তার বাবা মোহাম্মদ হোসেনও ছিলেন সাধক। তিনি ফতেহ আলীকে (র.) শিক্ষা অর্জনের জন্য ছামন্দর নামক স্থানে পাঠান। সেখানে সাধক মজনু শাহর সান্নিধ্যে নয় বছরের সাধনায় আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন ফতেহ আলী। মজনু শাহর মৃত্যুর পর তিনি ১৮ বছর চীনে এবং ২১ বছর ভারতের আজমীর শরিফে ধর্ম চর্চা করেন। ১৭৫৮ সালে করতোয়া নদীপথে বগুড়ায় আসেন। এরপর নদীর ঘাটে আস্তানা গেড়ে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ১৭৭৭ সালে তিনি মারা গেলে তাকে আস্তানায় শায়িত করা হয়। সেই থেকে তার ভক্ত আশেকানরা মাজারে খেদমত করেন। তার মৃত্যুর দিন ২২ বৈশাখ প্রতি বছর মাজারে ওরশ হয়। 

এদিকে, রী শ্রী শ্রী আনন্দময়ী মা কালী মন্দিরের সাইনবোর্ড অনুযায়ী, মন্দিরটি সেখানে স্থাপিত হয় আনুমানিক ১১৫৫ বঙ্গাব্দে। স্থাপনের পর থেকে চলে আসছে মন্দিরে পূজা অর্চনা। প্রতি বছর মন্দিরে সাড়ম্বরে কালীপূজা হয়।

শাহ ফতেহ আলী (র.) মাজারের খাদেম হায়দার আলী বলেন, ‘আমি ৬০ বছর ধরে মাজারে খাদেমের দায়িত্ব পালন করছি। আমার পূর্বপুরুষরাও এই মাজারে খেদমত করেছেন। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব আমার পূর্বপুরুষদের সময়েও ছিল না এবং আমি দায়িত্ব পালনের সময়েও হয়নি। তারা তাদের পূজাপার্বন করেন, আমরা আমাদের ইবাদত এবং অনুষ্ঠান করি। ভবিষ্যতেও কোনো দ্বন্দ্ব হবে না বলে আশা করি। পাশাপাশি দুই ধর্মের পূণ্যস্থান হলেও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব নেই বগুড়ায়, এটা দৃষ্টান্ত।’ 

একই কথা জানিয়ে রী শ্রী শ্রী আনন্দময়ী মা কালী মন্দিরের পুজারি পণ্ডিত ইন্দ্রজিৎ পান্ডে বলেন, ‘বংশ পরম্পরায় আমি মন্দিরের দায়িত্ব পালন করছি প্রায় ৪০ বছর। আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে জেনেছি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যারা কালী মাতার ভক্ত, তারা এখানে আসলে শাহ ফতেহ আলী (র.) মাজারেও যেতেন, প্রণাম করতেন। শ্রদ্ধাভক্তি জানাতেন। কোনো হিংসা ছিল না। আমিও দায়িত্ব পালনকালে এমনই দেখে আসছি।’ 

মন্দির কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মন্দিরে এসে ভক্তির পর মাজারে ভক্তি করেন। আমি নিজেও করি। এই মন্দিরে যখন পূজাপার্বন হয়, তখন দেখা গেছে— মাজার কমিটির লোকজনও কিন্তু এসে সহযোগিতা করে। আবার মাজারে কিন্তু প্রতি বছর ওরশ হয়। ওরশে পায়েশ এবং খিচুড়ি সিন্নি দেওয়া হয়। খিচুড়িতে কিন্তু কখনই গরুর মাংস দেওয়া হয় না। সব সময় খাসির মাংস দেওয়া হয়। ওরশের সিন্নি কিন্তু অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীর লোকজনও খায়। এটা অনেক সুস্বাদু হয়।’ 

এভাবে মিলেমিশে দুই ধর্মের লোক নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যুগ যুগ ধরে পালন করে যাচ্ছেন বলে জানান পরিমল প্রসাদ রাজ।
 

/বকুল/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়