ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২১ ১৪৩১

টাঙ্গাইল-৫ আসন

আ.লীগে কোন্দল, বিএনপি ও জাপার একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী

কাওছার আহমেদ, টাঙ্গাইল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ২২ অক্টোবর ২০২৩  
আ.লীগে কোন্দল, বিএনপি ও জাপার একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী

রাজনৈতিক দিক থেকে জেলার গুরত্বপূর্ণ আসন টাঙ্গাইল-৫ (সদর)। জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নাম প্রকাশ পাচ্ছে। এ আসনে সব দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা জোরেশোরে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। নির্বাচন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কোন্দল প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘চারাগাছ’ যুবলীগ নেতা ব্যাপক জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। 

অপরদিকে এ আসন থেকে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের সমর্থন ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্তুষ্ট করতে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন নেতারা। নির্বাচনী এলাকার অলি-গলিতে পোস্টার ও লিফলেট সেঁটে জনগণের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।  

সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেনের সঙ্গে উপজেলা ও শহর আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয় রয়েছে। তবে জেলা কমিটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়েছে। 

নেতাকর্মীরা জানান, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকলেও তিন দলেই রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এত দিন আওয়ামী লীগের কোন্দল গোপনে থাকলেও গত মে দিবসের শ্রমিক সমাবেশ পৃথকভাবে পালন করায় প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে শহরের শহীদ স্মৃতি পৌরউদ্যানে শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুক, শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আশরাফউজ্জামান স্মৃতি, সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান মিরন, যুবলীগের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য মামুনুর রশীদসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। 

অপরদিকে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন ও টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীরের নেতৃত্বে শহীদ মিনারে শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোন্দল প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। 

অপরদিকে ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘চারাগাছ’ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য মামুনুর রশিদ শহর থেকে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। 

এ দিকে বিএনপি কিছু দিন আগেও আলাদা আলাদা স্থানে সভা-সমাবেশ ও দলীয় কর্মসূচি পালন করেছে। গত বছরের ১ নভেম্বর গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়ে হাসানুজ্জামিল শাহীনকে সভাপতি ও ফরহাদ ইকবালকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করার পর ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা হতে থাকে। কর্মীদের মধ্যে সমঝোতা হলেও নেতৃত্ব পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা এখনও ফিরে আসেনি, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। জাতীয় পার্টির অবস্থাও একই।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তিনি খান পরিবারের অনুসারী হওয়ায় তার ক্লিন ইমেজে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি আওয়ামী রাজনীতির মূলধারায় নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে সচেষ্ট রয়েছেন। বর্তমান সংসদ সদস্য মো. ছানোয়ার হোসেন একজন সরল মনের মানুষ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে তিনি সহজে মিশতে পারায় তৃণমুল পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নের আসায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরকারের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘চারাগাছ’ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য মামুনুর রশিদ। 

তিন বারের সাবেক পৌর মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা জামিলুর রহমান মিরনও মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ আসনে তার ভোট ব্যাংক রয়েছে। এ দিকে বহু দিন থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন টাঙ্গাইলের এক সময়ের প্রতাপশালী সিদ্দিকী পরিবারের অন্যতম সদস্য মুরাদ সিদ্দিকী। এর আগে তিনি এ আসন থেকে বার বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন। প্রতিবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান এ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী, তবে তিনি বয়সের ভারে ন্যূব্জ। ইতোপূর্বে এ আসন থেকে তিনি চার বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, মন্ত্রীও হয়েছেন। জাতীয়তাবাদী যুব দলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এ আসন থেকে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় স্থানীয় নেতৃত্ব নড়েচড়ে বসেছে। সুলতান সালাউদ্দিন টুকু টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে দলীয় মনোনয়ন পান- ভেতরে ভেতরে স্থানীয় নেতৃত্ব এটা চায় না। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল। ফরহাদ ইকবাল গত পাঁচ বছর যাবত ব্যাপক গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার আহসান হাবিব এ আসনে প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের সব সময়ের প্রার্থী সৈয়দ খালেদ মোস্তফা বিএনপি দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় শহর ও গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পায়ে হেটে প্রচারণা চালাচ্ছেন, ভোট প্রার্থণা করছেন। স্বীয় প্রচারণার অংশ হিসেবে তিনি নিজের হাতে ব্যানার টাঙান, দেওয়ালে চিকা মারেন, পায়ে হেটে গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় দ্বারে দ্বারে গিয়ে দোয়া ও ভোট প্রার্থণা করছেন। 

জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চাইবেন ক্লিনম্যান হিসেবে পরিচিত শিল্পপতি আবুল কাশেম, জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক সাবেক সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম চাকলাদার ও জেলা জাপার সদস্য সচিব মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক। 

২০০৮ সালের নির্বাচনে আবুল কাশেম মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু পুরো সময় তিনি সংসদ সদস্য থাকতে পারেননি। ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়ের করা মামলায় তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান এবং বিএনপির মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। জাপা এবার মহাজোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে এ আসনের দাবিদার হিসেবে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবুল কাশেম, সালাম চাকলাদার ও মোজাম্মেল হক। 

২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম মনোনয়ন পান। ২০১৪ সালে এ আসনে জাতীয় পার্টির আব্দুস সালাম চাকলাদার মনোনয়ন পান। তবে পার্টির তৎকালীন চেয়ারম্যান এরশাদের আহ্বানে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। ওই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ছানোয়ার হোসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে এ আসনে মহাজোটের প্রার্থী উম্মুক্ত হয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ছানোয়ার হোসেন ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে পীরজাদা শফিউল্লাহ আল মুনির প্রতিদ্বন্দিতা করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছানোয়ার হোসেন পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনটি মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় নেতাকর্মীদের মাঝে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। 

একইভাবে জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিশসহ ছোটখাট দলগুলোর প্রার্থীরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠে এখনও তৎপরতা শুরু করেনি। 

জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে একাদশ সংসদ পর্যন্ত কাকতালীয়ভাবে এ আসনে বিজয়ী প্রার্থীর দলই সরকার গঠন করেছে। তবে, পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান জয়লাভ করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। সে হিসেবে টাঙ্গাইল-৫ সরকার গঠনেরই আসন। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবদুল মান্নান জয়লাভ করেছিলেন। এরপর যথাক্রমে বিএনপির আবদুর রহমান (১৯৭৯), জাতীয় পার্টির মীর মাজেদুর রহমান (১৯৮৬), জাতীয় পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান (১৯৮৮), পরবর্তীতে বিএনপির মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান (১৯৯১), বিএনপির মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি), আওয়ামী লীগের আবদুল মান্নান (১৯৯৬ সালের ১২ জুন), বিএনপির মাহমুদুল হাসান (২০০১), জাতীয় পার্টির আবুল কাশেম (২০০৮), আওয়ামী লীগের মো. ছানোয়ার হোসেন (২০১৪), আওয়ামী লীগের মো. ছানোয়ার হোসেন (২০১৮) পর্যায়ক্রমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

আওয়ামী রাজনীতিতে যোগ হয়েছেন খান পরিবারের বিপক্ষ শক্তি জার্মান প্রবাসী দুই ভাই সংসদ সদস্য ছোট মনির ও বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া (বড় মনি) ও সাবেক পৌর মেয়র জামিলুর রহমান মিরন। মিরন এবং বড় মনি ও ছোট মনির এক সময় মুরাদ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠজন থাকলেও সময়ের ক্রমধারায় তানভীর হাসান ছোট মনির এখন টাঙ্গাইল-২ আসনের সংসদ সদস্য। তার বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া বড় মনি জেলা বাস কোচ মালিক সমিতির মহাসচিব। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. ছানোয়ার হোসেন খান পরিবারের অনুসারী হওয়ায় তাদের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী খান পরিবারের মনমতো না হলে তাদের অনুসারীরা দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করবে অনেকে এ রকম ধারণা পোষণ করেন। তবে মো. ছানোয়ার হোসেন খান পরিবারের অনুসারী হলেও তার কর্মকান্ডে খান পরিবারের প্রভাব দেখা যায়নি। দশম ও একাদশ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মো. ছানোয়ার হোসেন কাজের মাধ্যমে অনেকটা ক্লিন ইমেজ তৈরি করেছেন। 

জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্র জানায়, এ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫১৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১৮ হাজার ২৯৭ জন ও নারী ২ লাখ ১৬ হাজার ২২১ জন।
 

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়