ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা

বিকট শব্দে পুরো এলাকা স্তম্ভিত, পড়ে থাকে খণ্ড-বিখণ্ড রক্তাক্ত দেহ

রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৩৮, ২৩ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ২২:৫৬, ২৩ অক্টোবর ২০২৩
বিকট শব্দে পুরো এলাকা স্তম্ভিত, পড়ে থাকে খণ্ড-বিখণ্ড রক্তাক্ত দেহ

এমন ঘটনায় কেউ সাক্ষী হলেন, আবার কেউ করলেন মৃত্যুকে সঙ্গী। যাত্রার শুরুতে সাধারণ মানুষ হয়তো ভাবেননি, নিরাপদ যাত্রায় এমন একটি দিন কারও জীবনে আসবে। ভৈরব জংশনের কাছে গাইনাহটি এলাকার মানুষজন এমন বিকট শব্দে দুই ট্রেনের সংঘর্ষের পর কিছু সময়ের জন্য হলেও স্তম্ভিত হয়েছিলেন। শত শত মানুষ ঘটনার পর দৌড়ে এসে দেখেছেন খণ্ড-বিখণ্ড মৃত মানুষের রক্তাক্ত দেহ।

সেই শত মানুষের একজন মো. ইব্রাহিম মিয়া (৬২)। বাড়ি ভৈরবের জগন্নাথপুর এলাকায়। ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি বলেন, আমি জন্মের পর এমন ট্রেন দুর্ঘটনা কখনও দেখেনি। কোথাও মানুষের মাথা, কোথাও পা, কোথাও পুরো শরীর লাইনে থেঁতলে গিয়েছে। পাশাপাশি মরদেহ, মালামাল ও ব্যাগ রক্তে রঞ্জিত হয়ে এখানে-সেখানে পড়েছিল। এমন দৃশ্য দেখে চোখে পানি চলে এসেছে। এমন কষ্টের মৃত্যু যেন আর কারও না হয়।

ট্রেন দুর্ঘটনায় যাত্রী হিসেবে আজকের ঘটনার সাক্ষী কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের শিক্ষক পল্লী এলাকার আতিকুর রহমান সেলিম। তিনি বলেন, জরুরি কাজে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব এসে আমাদের ট্রেনটি ইঞ্জিন ঘুরিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ভৈরব স্টেশন ছেড়ে কিছু দূর যেতেই বিকট এক শব্দ কানে ভেসে আসে। আর ট্রেনটিও কেঁপে উঠে। তারপর ট্রেনটি থেমে গেলে তাকিয়ে দেখি আমাদের ট্রেনের শেষের কয়েকটি বগি উল্টে গেছে। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নেমে দেখি বিপরীত দিক থেকে আসা একটি কন্টেইনারের ইঞ্জিনের সংঘর্ষে এমন দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক বড় একটি দুর্ঘটনার সাক্ষী হলাম। হয়তো আল্লাহ সহায় ছিলেন, তাই অল্পের জন্য আমরা বাকিরা বেঁচে গেলাম।

এখনও নিখোঁজদের সন্ধানে ছুটে আসছেন তাদের স্বজনরা। তাদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে ভৈরবের আকাশ-বাতাস। অনেক যাত্রী আটকা পড়ে আছেন ট্রেনের নিচে। সর্বশেষ ২৪ জন মৃতের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকাজ চালাতে ঢাকা থেকে একটি এবং আখাউড়া থেকে একটি ট্রেন উদ্ধার কাজ শুরু করেছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে, আহতদের রক্ত দিতে প্রস্তুত অনেকেই। বিভিন্ন মাধ্যমে ভৈরবে রেল দুর্ঘটনার খবর জেনেছেন কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া এলাকার উবায়দুল হক জুয়েল নামে এক তরুণ। কিশোরগঞ্জ ব্লাড ব্যাংকের সদস্য তিনি। এ ব্লাড ব্যাংকে দুই হাজারেরও বেশি সদস্য রয়েছে। তিনি জানান, দুর্ঘটনার খবর জানার পরই ফেসবুকে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে কারও রক্তের প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেছি। মানবিক কারণেই তিনি রক্ত দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। যে কারও রক্তের প্রয়োজনে তারা সাড়া দিতে প্রস্তুত বলে জানান তিনি।

প্রথমে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার কাজে সহায়তা শুরু করে। পরে রেলওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার কাজে আসে। এরপর র‌্যাব ও বিজিবি’র সদস্যরাও উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সোমবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় তাদের ভৈরব বাজার স্টেশন এলাকায় মোতায়েন করা হয়। বিজিবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ আরমান আরিফ।

তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা কাজ করছেন। তাদের সহায়তা করতে বিজিবি ২৫ ব্যাটালিয়নের তিন প্লাটুন সদস্য কাজ করছেন। যতক্ষণ প্রয়োজন আমরা কাজ করবো।

ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পর খবর পেয়ে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সুপার (এসপি) মো. রাসেল শেখ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় জেলা প্রশাসনের পক্ষে নিহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেন জেলা প্রশাসক। তিনি জানান, নিহতদের তালিকা করে পরিচয় শনাক্ত করে তাদের পরিবারের নিকট টাকা পৌঁছানো হবে। এছাড়া আহতদের চিকিৎসার জন্য সর্বাধিক ব্যবস্থার কথা জানান তিনি।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছিলেন কিশোরগঞ্জ-৬ (ভৈরব-কুলিয়ারচর) আসনের এমপি নাজমুল হাসান পাপন। তিনি বলেন, ভৈরবের ইতিহাসে এটি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। নিহত ও আহতদের জন্য সরকারিভাবে অচিরেই বরাদ্দ ঘোষণা করা হবে। নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার কাজ চলছে। তাছাড়া আহতদেরও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, সোমবার (২৩ অক্টোবর) বিকেল পৌনে ৪টার দিকে মালবাহী ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। একই সময় ভৈরব থেকে ঢাকায় যাচ্ছিল যাত্রীবাহী ট্রেন এগারো সিন্ধুর গোধুলী। ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষ তিন বগিতে ধাক্কা দেয় মালবাহী ট্রেনটি। এতে যাত্রীবাহী ট্রেনের কয়েকটি বগি উল্টে যায়। বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, সিগনালিংয়ের কোনও জটিলতার কারণে ঘটনাটি ঘটেছে।

ঢাকা/এনএইচ

ঘটনাপ্রবাহ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়