ইছামতী নদীতে ফিরবে প্রাণ, পাবনাবাসীর মধ্যে উচ্ছ্বাস
পাবনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
ঝোপ-জঙ্গলে পরিপূর্ণ ইছামতী নদী
পাবনা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃত প্রায় ইছামতী নদীতে এবার প্রাণ ফেরার আশা জেগে উঠেছে। মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) ‘ইছামতী নদী পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প’ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন হয়েছে। আর এই খবরে পাবনাবাসীর মধ্যে ইছামতী নদী নিয়ে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।
ইছামতী নদী উদ্ধারে আন্দোলনকারী, নাগরিক সমাজ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর নেতারা ইছামতী পুনরুজ্জীবিতকরণ প্রকল্প হাতে নেওয়ায় সাধুবাদ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে। সব বাধা উপেক্ষা করে অবশেষে ইছামতী নদী উদ্ধার ও চালু হলে পাবনাবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গতি আসবে বলে মনে করছেন তারা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলার নবাব ইসলাম খাঁ ১৬০৮-১৬১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে সৈন্য পরিচালনার সুবিধায় পদ্মা ও যমুনা নদীর সংযোগ স্থাপন করতে পাবনা মধ্যশহরে একটি খাল কাটেন। এই খালটির নাম দেন তিনি ইছামতী। প্রবাহমান সেই ইছামতী তার যৌবন হারিয়ে এখন বিপন্নের পথে। মৃত ইছামতী এখন ময়লা-আবজর্নার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নদীর দুইপাড় দখল করে বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালীরা।
পাবনা থেকে বেড়া পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর প্রায় অর্ধেক এখন নর্দমা। এর মধ্যে পাবনা পৌর এলাকার মধ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার বতর্মানে ময়লা-আবজর্নার দুর্গন্ধ ও মশা-মাছির আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এ নদীতে প্রবাহ ছিল।
গত তিন বছরে নদীতে দুইদফা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও খননকাজ করা হয়। কিছুদিন কাজ চলার পরই দখলদারদের মামলায় থমকে যায় কাজ। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ পাবনা শহরবাসী। মো. সাহাবুদ্দিন দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পাবনার উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। তারই অন্যতম একটি প্রচেষ্টা ইছামতী নদী পুনরুজ্জীবিত প্রকল্প। যা একনেকে অনুমোদন হয় মঙ্গলবার। এই খবর পাবনায় জানাজানি হলে জেলাবাসীর মাঝে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। আনন্দে দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
পাবনার প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শিবজিত নাগ বলেন, ‘ইছামতী নদী আমাদের প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু এতো বছর ধরে নদীটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। বারবার উদ্ধারের উদ্যোগ থমকে গেছে। দেরিতে হলেও ইছামতী নদী অবৈধ দখলমুক্ত হবে। খনন হয়ে আবার ইছামতীতে প্রাণ ফিরবে এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। ইছামতী নদী উদ্ধার প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হওয়ায় আমাদের আনন্দের ভাষা নেই। এজন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’
ইছামতী নদী উদ্ধার আন্দোলন পাবনার সভাপতি এস এম মাহবুব আলম বলেন, ‘খবরটি আমাদের জন্য খুবই আনন্দের। আমরা অনেক বছর ধরে নদীটি উদ্ধারে আন্দোলন করছি। অবশেষে রাষ্ট্রপতির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেই স্বপ্ন সফল হওয়ার পথে অনেকদূর এগিয়ে গেলো। আমরা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পাবনা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ খান বলেন, ‘ইছামতী নদী উদ্ধারে আমরা দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে আন্দোলন করছি। নদী উদ্ধার ও খনন হলে এখানে মাছ পাওয়া যাবে। নির্মল বাতাস পাবে মানুষ। পাবনা একটি নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ে উঠবে। তাই ইছামতী নদী প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হওয়ায় আমরা আনন্দিত।’
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছেলে ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আরশাদ আদনান রনি বলেন, ‘পাবনাবাসীর প্রাণের দাবি ছিল ইছামতী নদী উদ্ধার করে শহরের সৌন্দর্য বাড়ানোর। মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মধ্যে পাবনাবাসীর জন্য এই কল্যাণ বয়ে আনায় আমরা গর্বিত। এটা অনেক বড় একটি পাওয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে ১৫৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ইছামতী নদী অবৈধ দখলমুক্ত ও খনন করা হবে। এরপর হাতিরঝিল আদলে ব্রিজ, দুই পাশে ওয়াকওয়ে, শিশুদের বিনোদন পার্ক নির্মাণ করা হবে। সবমিলিয়ে মানুষ নানাভাবে উপকৃত হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড পাবনা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ইছামতী নদীর দুই পাড়ের ৫ দশমিক ৬৭ কিলোমিটারে দখলদার উচ্ছেদের জন্য ২ কোটি ৭৯ লাখ এবং ২ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার নদী খননের জন্য ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় এক বছর। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ১ হাজার ৫৩টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করে। এরপর ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে শহরের লাইব্রেরি বাজার ব্রিজ এলাকা থেকে উৎসমুখের দিকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। উচ্ছেদ করা হয় ৬১০টি অবৈধ স্থাপনা। উচ্ছেদ এলাকায় শুরু করা হয় নদী খননের কাজ। এর কয়েক মাসের মধ্যেই মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় উচ্ছেদ অভিযান। ফলে মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ শেষ না হতেই প্রকল্প এলাকা ছেড়ে চলে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর চার দফা প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আর উচ্ছেদ ও খননকাজ শুরু করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, ২ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার নদীখনন প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়। অন্যদিকে ৫ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার এলাকায় দখলদার উচ্ছেদ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় এ বছরের জানুয়ারিতে। উচ্ছেদ কার্যক্রমে ৫৮ শতাংশ ও খননকাজে ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পাবনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিনের সাথে কথা বলার জন্য কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
শাহীন/মাসুদ