ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২১ ১৪৩১

টাঙ্গাইল-৮ 

আ.লীগ-বিএনপির নেতারা ব্যস্ত প্রচারণায়, হেভিওয়েট কাদের সিদ্দিকী

কাওছার আহমেদ, টাঙ্গাই || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৩, ৩ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৯:০৫, ৩ নভেম্বর ২০২৩
আ.লীগ-বিএনপির নেতারা ব্যস্ত প্রচারণায়, হেভিওয়েট কাদের সিদ্দিকী

টাঙ্গাইল-৮ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা

মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার হিসেবে খ্যাত টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসন। এই আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল জেলার রাজনীতিতে বড় ধরণের ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া বিরাজমান। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পর জেলার আওয়ামী রাজনীতিতে পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। 

এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামীল লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম (ভিপি জোয়াহের)। সজ্জন ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। তিনিও এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি সার্বক্ষনিক মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনছেন। সভা-সমাবেশ ও সাংগঠনিক কর্মসূচিতে সরকারের উন্নয়নের বিশদ বর্ণনা দিচ্ছেন। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকাকে বিজয়ী করতে উদ্বুদ্ধ করছেন। 

বাসাইল-সখীপুরের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার মূলে জোয়াহেরুল ইসলামের দক্ষ প্রার্থী বাছাইকেই প্রকৃত কারণ বলে মনে করেন স্থানীয় নেতারা। টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। তার সমর্থকদের দাবি- নির্বাচনে উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে একমাত্র তার নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার বিজয় ধরে রাখা সম্ভব। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানের মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত বলে মনে করছেন তার কর্মী-সমর্থকরা। জেলা বিএনপির কমিটি গঠনে প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়লেও পরে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করায় তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি প্রচারণায় সরব। ইতোমধ্যেই এলাকাবাসীর সঙ্গে নিয়মিত কুশল বিনিময় করে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। এছাড়া, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক এনাম জয়নাল আবেদীন ও কেন্দ্রীয় নেতা কাজী আশরাফ সিদ্দিকী ও রেজাউল করিম নিজ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী সখীপুর উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি বনাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারন্য গড়ে তোলেন। গঠন করেন দুর্ধর্ষ কাদেরিয়া বাহিনী। সখীপুরের মহানন্দপুর গ্রামে বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল। সখীপুর থেকেই এই বাহিনী সমগ্র টাঙ্গাইল এবং যমুনা-ধলেশ্বরী নদী সংলগ্ন এলাকা এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর জেলায় গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতো। বহেড়াতৈল বাজারের পাশে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা শপথ গ্রহণ করতেন। সেখানে একটি শপথ স্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও পুরোপুরি সম্পন্ন করা হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আশপাশে অপারেশন (তাদের ভাষায়) চালালেও সখীপুরের গহীন বনের একটি অংশ সব সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। দুর্ধর্ষ এই বাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি। এজন্য নানা দিক থেকেই টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে এ আসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী তার কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল অথবা মহাজোটের সাথে জোটভুক্ত হয়ে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভা-সমাবেশে বঙ্গবীরের বক্তব্য সে ধারণাকে পাকাপোক্ত করছে। কাদের সিদ্দিকীর মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রণ্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। 

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম এ আসন থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ১৯৯৯ সালে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে নতুন দল গঠন করেন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ব্যানারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বড় কোনো রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গেই তাকে নির্বাচনে লড়তে হবে। সে ক্ষেত্রে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম ও বিএনপির অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান। প্রধান দুই দলের এ দুই নেতার দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত না হলেও তারাই আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন। তবে, আগামী নির্বাচনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাবেন এমন গুঞ্জনে একদিকে কিছুটা উদ্বেগে রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সখীপুর ও বাসাইল উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদের ১৩৭ টাঙ্গাইল-৮ আসন গঠিত। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলার দেলদুয়ার উপজেলার সুবর্ণতলী গ্রামের অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ, ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী মুর্শেদ আলী খান পন্নী, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মুর্শেদ আলী খান পন্নী, ১৯৯১ সালে পঞ্চম এবং ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হুমায়ুন খান পন্নী, ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, ১৯৯৯ সালের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের প্রতিষ্ঠিত কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রার্থী বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, ২০০৮ সালে নবম এবং ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহান নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শওকত মোমেন শাহজাহান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই শওকত মোমেন মারা যান। সেসময় এই আসনের উপ-নির্বাচনে তারই ছেলে অনুপম শাহজাহান জয় বিজয়ী হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম (ভিপি জোয়াহের) নির্বাচিত হন। 

টাঙ্গাইল-৮ আসনের চারবারের সংসদ সদস্য কৃষিবিদ শওকত মোমেন শাহজাহানের মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে তারই ছেলে অনুপম শাহজাহান জয় সংসদ সদস্য  হন। সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনুপম শাহজাহান জয় এলাকার সন্তান হিসেবে নিয়মিত প্রত্যেকটি এলাকায় আসা-যাওয়া করছেন। বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরছেন। 

সখীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরপর দুই বারের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শওকত শিকদার দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এর আগেও দলের কাছে তিনি মনোনয়ন চেয়েছেন। মনোনয়ন পেতে তিনি দুই উপজেলাকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের ভাইস-চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আতাউল মাহমুদও মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়ে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। 

এদিকে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা আগে থেকেই দুই উপজেলার আনাচে-কানাচে সভা-সেমিনার ও গণসংযোগে ব্যস্ত  থাকলেও গত বছরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের দেখা করার পর তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কা বিরাজ করছে। কাদের সিদ্দিকী কি আওয়ামী লীগে ফিরে আসছেন, নাকি মহাজোটে যোগ দিচ্ছেন- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ঘরে-বাইরে। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই।

এ বিষয়ে স্থানীয় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাকর্মীরা জানায়, তাদের নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন। তারা সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে এ আসনে নিজ দল থেকে এককভাবে নির্বাচন করারও পূর্ণ প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। তারা জানান, বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্যসহ তাদের বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। দল যাকেই মনোনয়ন দেবে এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন। সেক্ষেত্রে বর্তমান সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা জোয়াহেরুল ইসলামের (ভিপি জোয়াহের) দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভবনা বেশি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানের মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত বলে মনে করছেন তার কর্মী-সমর্থকরা। আযম খান ছাড়াও জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন শিল্প বিষয়ক সম্পাদক ও সখীপুর উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোহাম্মদ হাবিব দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।

আযম খান ছাড়াও জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন শিল্প বিষয়ক সম্পাদক ও সখীপুর উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোহাম্মদ হাবিব দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। জনগণের নানা সমস্যায় তিনি আন্তরিকতার সাথে অংশ নেন- সমাধানের চেষ্টা করেন। এ অবস্থানের কারণে তিনি জনগণের দোরগোড়ায় একটা জায়গা করে নিয়েছেন। তাকে মনোনয়ন দিলে তৃণমূলের ভোটে অতি সহজেই নির্বাচিত হয়ে এ আসনটি রক্ষা হতে পারেন বলে তার কর্মী-সমর্থকরা মনে করেন। 

জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক এনাম জয়নাল আবেদীন ও কেন্দ্রীয় নেতা কাজী আশরাফ সিদ্দিকী ও রেজাউল করিম নিজ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ আসনে তিন দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে কারো জন্যই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সহজ হবে না। 

জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্র জানায়, টাঙ্গাইল-৮ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৩১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৯৩ হাজার ১১২ জন ও নারী ভোটার রয়েছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩১৬ জন।

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়