আলোর মুখ দেখছে না প্রথম রেলওয়ে স্টেশন কুষ্টিয়ার জগতি
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
আধুনিকায়নের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত দেশের প্রথম চালু হওয়া জগতি রেলওয়ে স্টেশনটির এখন জীর্ণ দশা। নান্দনিক দোতলা ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেড়শ’ বছরের বেশি পুরনো স্টেশনটি এক সময় সারাদিন রমরমা ও হাঁকডাক থাকলেও এখন নিষ্প্রাণ। অফিসিয়ালি কোনো ট্রেন থামে না। তাই ঘন্টা বাজে না, বিক্রি হয় না টিকিট। স্টেশনটির সংষ্কার করে এর বিশাল জায়গা কাজে লাগিয়ে আগের রূপে ফিরিয়ে আনার দাবি জনসাধারণের। রেলওয়ে বিভাগ জগতি স্টেশনকে আধুনিকায়ন ও জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
নথিপত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর। ভারতের রানাঘাট থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়। কুষ্টিয়ার জগতিতে নান্দনিক দোতলা স্টেশন নির্মাণ করা হয়।
শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ৩০০ বিঘা জমির উপর নির্মাণ করা হয় স্টেশনটি। দেশের রেল যোগাযোগের শুরুটা হয় কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনের মাধ্যমে। সেটাও আজ থেকে প্রায় ১৬১ বছর আগে। ভারতের রানাঘাট থেকে প্রতিদিন যাত্রী ও মালামাল বোঝাই ট্রেন আসত জগতি স্টেশনে। সেই সময় থেকে হাঁকডাকে মুখর থাকতো স্টেশনটি।
সরেজমিনে স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, সে সময়কার ঘণ্টাটি এখনো ঝুলানো আছে স্টেশন মাস্টারের কক্ষের সামনে। তবে সেটি আর বাজে না। বন্ধ হয়ে পড়ে আছে স্টেশন মাস্টারের কক্ষ। তবে সেটি মাঝে মধ্যে খোলা হয়। স্টেশনটির গেটম্যান আব্দুর রাজ্জাকের কাছে চাবি আছে। সেখানে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরের জন্য তিনি খোলেন।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘অফিসিয়ালি কোন ট্রেন থামে না জগতি স্টেশনে। তবে দিনে একটি লোকাল ট্রেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে পোড়াদহ জংশন পর্যন্ত আসা-যাওয়া করে। আর খুলনা থেকে গোয়ালন্দগামী একটি মেইল ট্রেন সকালে এসে বিকেলে ছেড়ে যায়। জগতি স্টেশনে কয়েক মিনিটের জন্য থামে এই দু’টি ট্রেন। টেলিফোন লাইন সচল না থাকায় গেটম্যানের কাজের পাশাপাশি মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করি ট্রেনের পরিচালকের সাথে। এভাবে আমি কাজ করছি।’
স্টেশনটির বিশাল জাগয়া আছে। বড় বড় পুকুর আছে তিনটি। আম, কাঁঠালসহ অন্যান্য গাছ রয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০টি। এসব পুকুর ও গাছ লিজ দেওয়া হয়। স্টেশনটির উত্তর দিকে ফরজ আলীর চায়ের দোকান। তিনি ১৩ বছর বয়সে পাকিস্থান আমলে জগতি স্টেশনে পাম্প অপারেটর পদে চাকরি নেন।
ফরজ আলীর বয়স এখন ৭০ বছর। তিনি চায়ের দোকান চালান। তিনি বলেন, ‘সে সময় স্টিম ইঞ্জিনের (কয়লা চালিত) ট্রেন চলাচল করতো। ভারতের রানাঘাট থেকে যাত্রী ও মালামাল বোঝাই করে প্রতিদিন ট্রেন আসত। বিশেষ করে প্রচুর খাদ্যশস্য ও মাছ আসতো। আমার কাজ ছিলো ইঞ্জিনে পানি দেওয়া। সামান্য বেতনে অস্থায়ীভাবে কাজ করতাম। পানি দেওয়ার জন্য সে সময় দুটি বড় বড় ট্যাংক নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর আর চাকুরি স্থায়ী হয়নি।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এত বড় জায়গা কম স্টেশনের আছে। বড় কিছু পড়ে আছে। ব্যবহার করা হচ্ছে না। জগতি ছাড়া কুষ্টিয়া শহরের মধ্যে আরো দুটি স্টেশন আছে। যে কারণে যানজট হয়। ওই দুটি স্টেশন বন্ধ করে জগতি স্টেশনকে আধুনিকায়ন করা হলে সবার সুবিধা হয়।’
স্টেশনে অবস্থান করার সময় পোড়াদহ থেকে লোকাল ট্রেনটি যাত্রী নিয়ে জগতিতে থামে। বেশ কিছু যাত্রী নামেন। উঠেন ২০ থেকে ৩০ জনের মত। এদের একজনের সাথে কথা হয় আগেই। নাম হাসান আল মাহমুদ। বাড়ি সদরের আলমপুরে। তিনি চাকুরি করেন মানিকগঞ্জে। গোয়ালন্দ যাবেন বলে জানান।
তিনি বলেন, ‘দেশের ঐতিহাসিক একটি স্থাপনা জগতি রেলওয়ে স্টেশন। এটি সংরক্ষণ করার দায়িত্ব সরকারের। বিশাল জায়গা পড়ে আছে। সুন্দর একটি পরিবেশ আছে এখানে। মানুষ ঘুরতে আসে। তাই স্টেশনটি চালুর দাবি সকলের।’
স্থানীয় ভ্যানচালক আজহার আলী বলেন, ‘এক সময় স্টেশনটি রমরমা থাকতো। প্রচুর মানুষ আসা-যাওয়া করতো। এখন এই রুট দিয়ে ঢাকায় ট্রেন যাবে। তাই স্টেশনটি নতুন রুপে চালু হওয়া দরকার।’
দেখা গেছে, দামী সব যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। ঝোঁপ-ঝাঁড়ে ঢেকে গেছে নান্দনিক ভবনটি। ভবঘুরে লোকজনের আবাস স্টেশনটির বারান্দা। অনেক ফকিরও রাতে থাকেন বলে জানা গেছে। নেশাখোর লোকজনের আনাগোনা বাড়ে রাতে।
কয়েক বছর আগে জগতি স্টেশনকে সংষ্কার করে নতুন আঙ্গিকে চালু করার পাশাপাশি একটি রেল জাদুঘর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হলেও সেটি আলোর মুখে দেখেনি। ঘটা করে স্টেশনটির জন্মদিনও পালন করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. এহতেশাম রেজা বলেন, ‘জগতি বাংলাদেশে চালু হওয়া প্রথম স্টেশন। নানা কারণে সেটি এখন বন্ধ আছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে স্টেশনটি চালু করার পাশপাশি ভবনগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া রেল মন্ত্রণালয় এখানে জাদুঘরসহ অন্যান্য যেসব স্থাপনা করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেগুলো যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয় সে ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
কাঞ্চন/ফয়সাল