বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল, এখনও শরীরে তার যুদ্ধের ক্ষত
আব্দুল্লাহ হেল বাকী, জয়পুরহাট || রাইজিংবিডি.কম
![বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল, এখনও শরীরে তার যুদ্ধের ক্ষত বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল, এখনও শরীরে তার যুদ্ধের ক্ষত](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2023December/joypurhat-2312070652.jpg)
বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন একাত্তরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া লাখো মুক্তি সেনাদের তিনি একজন।
নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৫৬ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের কোল ঘেঁষে ধামইরহাট উপজেলায় তার জন্মস্থান। জন্ম ৯ জানুয়ারি, ১৯৪৬। উমার ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষকের সন্তান আফজাল হোসেন। তিনি ধামইরহাট উপজেলা পৌর শহরের দক্ষিন চকযদু টিএন্ডটি মহল্লার বাসিন্দা। এখন তিনি ছেলের বাসা জয়পুরহাট ও মেয়ের বাসা ধামইরহাট দুই জায়গাতেই থাকেন।
৭১-এর উত্তাল মার্চে ঢাকা শহরের মতো যখন সারা দেশেই পাক সেনাদের চলছে তাণ্ডব। নওগাঁর সীমান্ত ঘেঁষা উপজেলা ধামইরহাট তখন এমনই এক তাণ্ডবময় এলাকা। এলাকার মানুষগুলোর অধিকাংশই তখন সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। সদ্য গ্রাজুয়েট হওয়া আফজাল হোসেন দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সে দৃশ্য। সীমান্তের ওপারে যদি যেতেই হয়, তবে ফিরে আসবো ট্রেনিং নিয়ে। রুখবো পাক সেনাদের। কিন্তু ভাবনাটা বাস্তবে রূপ পাবার আগেই ছোট্ট বাজারটাতে হানা দিয়েছে পাকি বাহিনী। উপায়ন্তর না দেখে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দুরে আত্রাই নদীতে লুকিয়ে কাটান সারা দিন। তারপর কাউকে না জানিয়েই যুদ্ধযাত্রা।
প্রথমে ৭নং সেক্টরে বাঙালিপুর ক্যাম্পে ভর্তি হন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইকুড়ি জেলার মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে যোগদান করেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার রউফের অধীনে যুদ্ধ করেন। বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে তাকে নওগাঁর ধামইরহাট, রাঙ্গামাটি, র্ফাশিপাড়া, হিলি, চৌঘাট ডাঙ্গি এলাকার পাকহানার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো হয়। বিজয়ের ঊষালগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি ফিরেন পরিবারের কাছে।
তিনি ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের দিকে প্রথমে পাকিস্তানি সেনাদের তাড়া খেয়ে বাড়ি থেকে ৫ মাইল দুরে আত্রাই নদীতে মাথা বের করে পানির নিচে ডুবে থাকেন। পরদিন বাড়ি ফিরে ধামইরহাট উপজেলার শেষ সীমানা আলতাদিঘীর পূর্ব পাড়ে পালিয়ে যান। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য মন স্থির করেন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে বাবা মাকে না বলে বাঙালিপুর ইয়থ ক্যাম্পে ভর্তি হন। পরদিন সেখানে ভর্তি হন আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা হলেন, আব্দুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অনেকেই। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবুল আজাদ। সেখানে এক মাসের ট্রেনিং দেওয়ার পর ১০০ জনের একটি টিমকে আর্মি ভ্যানে জলপাইগুড়ি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানে মেজর রেড্ডীর অধীনে ট্রেনিং করেন। জলপাইগুড়ি অর্মি ক্যাম্প থেকে ১৫ দিন পর সবাইকে বিমানে করে দর্জিলিং বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরের দিন উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া দেরাদুন নামক স্থানে এক মাস ট্রেনিং হয় মেজর মালহুতরা ও মেজর চোয়ানের অধীনে।
ট্রেনিং শেষে আফজাল হোসেন, আব্দুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অন্তত ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধাকে ধামইরহাট এলাকার কালুপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয় এবং বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর চৌঘাট ডাঙ্গী নামক স্থানে যুদ্ধের জন্য অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আত্রাই নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে শত্রুর অবস্থানের দিকে এগোতে থাকেন। এমন সময় তার মাথার উপর দিয়ে গুলি হচ্ছিলো ঠিক তখন তিনি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় বাম হাতটি ভেঙে যায় এবং বাম পায়ের হাঁটুর নিচে সামান্য গুলির ছটা লাগে। এখন সেই হাতটি ভালো হলেও আজও বাঁকাই আছে এবং পায়ের গুলির দাগটি এখনও রয়ে গেছে। এভাবে এগোতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত ঐ সময় সামনা সামনি যুদ্ধে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার প্রাণের বন্ধু লোকমানের দেহে। একই সময় কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিকও মারা যায়। সেদিন ছিলো ১৪ ডিসেম্বর। তার ২ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের কথা জানতে পারেন তিনি।
যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া পাননি কোনো খেতাব বা পদবি। ধামইরহাটে পাক বাহিনীর দুর্গে আঘাত হানার পেছনে অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে অবিস্মরনীয় ভুমিকা রেখেছেন আফজাল হোসেন। বর্তমানে তিনি যখনই যাকে কাছে পান তখনই বলতে থাকেন ৭১-এর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা। আফজাল হোসেন এখনও বেঁচে আছেন শরীরে যুদ্ধদিনের সেই ক্ষত নিয়ে। বেঁচে আছেন শহীদ লড়াকু সব মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে।
/টিপু/
আরো পড়ুন