ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৪ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২০ ১৪৩১

‘দুইবার সম্মুখ যুদ্ধেই আমরা সা‌রিয়াকান্দি মুক্ত করি’

বগুড়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৭, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩  
‘দুইবার সম্মুখ যুদ্ধেই আমরা সা‌রিয়াকান্দি মুক্ত করি’

মুক্তিযোদ্ধা সুরুতজামান

পাকিস্তানী আর্মিদের ক্যাম্পে হামলা করতে যাবো এর দু’একদিন আগে শহীদুল নামে একজন রাজাকারকে আমরা ধরে ফেলি। ও আর্মিদের ইনফরমার হিসেবে কাজ করতো। এছাড়া সে বিভিন্ন গ্রাম থেকে গরু-খাসিসহ মেয়েদের ধরে নিয়ে আর্মিদের দিতো। ওকে ধরার পর মাটিতে একটি বাঁশ খাড়া করে পুঁতে ফেলা হয়। পরে ওই বাঁশের সাথে তাকে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর পা থেকে পুরো শরীর পাট দিয়ে পেচানোর পর কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় ওই রাজাকারকে। এভাবেই স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন বগুড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম সুরুতজামান। তিনি বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তার গ্রুপের ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
 
সুরুতজামান বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুঠিবাড়ী গ্রামের সাদেক আলী প্রামানিকের ছেলে।  ১৯৬৬ সালে তিনি এসএসসি পাশ করার পর বগুড়ায় চলে আসেন। বগুড়া শেরপুর কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ফুটবল খেলতেন। বগুড়া জেলা দলের হয়ে এবং ইউএফসি ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ২২ বছর বয়সের যুবক। এখন তার বয়স ৭৬।  বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বগুড়া জেলা ডেপুটি কমান্ডার এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বগুড়া ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি রাইজিংবিডির বগুড়া প্রতিনিধি এনাম আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা সুরুতজামানের সাথে যোগাযোগ করেন তার সাথে যুদ্ধকালীন ঘটনার জানার জন্য। তিনি জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে তিনি কিভাবে অংশ নেন এবং কিভাবে যুদ্ধ করে জয়ী হন। 

মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম সুরুতজামান বলেন, ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন অসহযোগ আন্দোলন হচ্ছিলো, ওই সময় বগুড়াতে যখন টিকে থাকা যাচ্ছিলো না। তখন আমি বগুড়া থেকে পালিয়ে গাবতলী হয়ে আমার গ্রামের বাড়ি সারিয়াকান্দি চলে যাই। এরপর আমার বাবার সাথে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আলোচনা করি।  বাবা নির্ভয় দেন। তখন সারিয়াকান্দিতে নদীপথ ছিলো। আমি আরও ২৫ জন ছেলেকে সাথে নিয়ে নৌকাপথে রওনা দিই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। আমরা ট্রেনিং নিতে ভারতের উত্তরপ্রদেশের টান্ডুয়াতে যাই। সেখানে সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, ধুনট এবং বগুড়া সদর উপজেলার অনেক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়েছেন। সময়টা ছিলো শীতকাল। টান্ডুয়াতে আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে আমাদেরকে ট্রেনিং করানো হয়। ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিলো মাটি থেকে সাড়ে ১০ হাজার ফুট উপরে। পাহাড়ে। সেখানে ৪২ দিন ট্রেনিং করানো হয়। এটি মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প ছিলো। আমাদের স্পেশাল গেরিলা ট্রেনিং করানো হয়।

সুরুতজামান বলেন,  আমাদেরকে হালকা ও ভারী অস্ত্র চালানো থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট উড়ানো এবং গাছ কাটার ট্রেনিং দেয়া হয়। আমাদের সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধ করা বারণ ছিলো। আমাদের শেখানো হয়েছিলো শত্রুদের রাতে ডিস্টার্ব করতে হবে। আমাদের বলা ছিলো, আমাদের নিকটস্থ কোন ক্যাম্প চোখে পড়লে রাতে ওই ক্যাম্পে গিয়ে গুলি করে পালিয়ে আসতে। যাতে করে ওরা সারারাত না ঘুমায়। অথবা কোন তথ্য পাওয়া গেলো একটি রাস্তা দিয়ে পাকসেনারা আসবে ওই রাস্তায় একটি মাইন পুতে রেখে আসতে হবে। এতে করে বোম্ব ব্লাস্ট হলে তারা আর বের হতে পারবে না। ট্রেনিং থেকে আমাদের এই কৌশলগুলো শেখানো হয়।
 
ট্রেনিং শেষ করার পর আমার যুদ্ধ এলাকা ছিলো সারিয়াকান্দি। ট্রেনিং শেষে নওগাঁর ধামইরহাট বর্ডার দিয়ে আক্কেলপুর হয়ে মোলামগাড়ী দিয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জে পৌঁছাই। এভাবে সারিয়াকান্দি আসি। আমরা রাতে রওনা দিতাম। ভোর হলে জঙ্গলে বা কোন বাড়িতে আশ্রয় নিতাম। টান্ডুয়া থেকে আমরা ৭৫ জন বগুড়ায় আসি। এর মধ্যে বগুড়া সদরের ছিলো ১০ জন। গাবতলীর ছিলো ১০ জন। ধুনটের ছিলো ১০ জন। বাদবাকী সবাই সারিয়াকান্দির ছিলো। 
তিনি বলেন, সারিয়াকান্দি ছিলো মুক্ত এলাকা। কারণ, এটি নদী এলাকা। তখন উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি, সুখদহ নদীতে প্রচুর পানি ছিলো। এই নদীগুলো পার হয়ে পাক আর্মিরা ওদিকে যেতে পারেনি। কারণ তাদের গাড়িসহ যাওয়ার উপায় ছিলো না। যে কারণে সারিয়াকান্দি, ধুনট উপজেলায় মুক্তিবাহিনী শেল্টার নিয়েছিলেন বেশি পরিমাণে।
মুক্তিযোদ্ধা সুরুতজামান বলেন, আমরা সারিয়াকান্দি মুক্ত করেছি ২৬ নভেম্বরে। একেবারে সম্মুখ যুদ্ধে গিয়ে। যদিও আমাদের সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়া নিষেধ ছিলো। তারপরেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলো সেখানে। তারা সবাই সম্মুখ যুদ্ধই করতে চাচ্ছিলো। পরে আমরা সারিয়াকান্দি উপজেলার রামচন্দ্রপুর মুক্তিযোদ্ধাদের ১৪টি গ্রুপের একজন করে একত্র হয়ে মিটিং করি নভেম্বরের ২৪ তারিখ রাতে। এর আগে আর্মিদের একটি গ্রুপ রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটে নৌকাতে উঠতে যাচ্ছিলো। এসময় খেয়াঘাটের উপর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ সেখানে হামলা চালিয়ে একজন আর্মিকে হত্যা করে। পরে পাকিস্তানী আর্মি সেখান থেকে পালিয়ে যায়। নদীর ঐ পাড়ে যেতে পারে না। এর দুইদিন পরই আমরা আস্তানায় তাদেরকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করার মিটিং করি।

তিনি বলেন, সরাসরি পাকিস্তানীদের সঙ্গে আমাদের দুইবার সম্মুখ যুদ্ধ হয়। আমাদের কাছে তথ্য ছিলো পাকিস্তানী সেনা এবং রাজাকাররা জানতে পেরেছে সারিয়াকান্দিতে মুক্তিবাহিনী বেশি পরিমাণে আছে। তারা আমাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। এ কারণে তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পন করবে। কিন্তু যেহেতু সারিয়াকান্দিতে মুক্তিযোদ্ধা বেশি ছিলো। তারা তাদের আত্মসমর্পনের বিষয়টি মানতে চায়নি। যে কারণে প্রথমদিন ২৫ নভেম্বর প্রস্তুতি নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করতে করতে বেলা উঠে যায়। এরপর তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা আর তাদের সাথে টিকতে পারিনি। ঐদিন আমরা ফিরে আসি। পরদিন আমরা দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিক থেকে তাদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালাই। ওই ক্যাম্পে ১০ জন আর্মি ছিলো। দিনভর যুদ্ধের পর আমরা জয়ী হই। এসময় ১০ জনের মধ্যে ৭ জন আর্মি নদীর ধার দিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা ৩ জনকে ধরে ফেলি। পরে সেখানেই আমরা তাদের হত্যা করি। এছাড়া  ৪০ জন রাজাকার, ৫ জন পুলিশকে আমরা আটক করি ওই এলাকা থেকে। পরদিন ২৭ নভেম্বর আর্মিরা প্লেন নিয়ে এসে সারিয়াকান্দি থানায় উপর থেকে বোম্বিং করে চলে যায়। কিন্তু আমরা তো আগের দিনই সারিয়াকান্দিকে মুক্ত করার পর যে যার মতো ওই এলাকা ত্যাগ করেছিলাম।

রাজাকার আর পুলিশদের ধরলেন, পুলিশরা কি আর্মিদের পক্ষেই ছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ আর্মিদের পক্ষেই ছিলো। আমরা থানা থেকেই পুলিশদের ধরেছিলাম। রাজাকারদের কি করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজাকারদের ৬ গ্রুপে ভাগ করে দিই। কারো গ্রুপে ১০ জন রাজাকার। কারো গ্রুপে ৬ জন।  মকবুল নামে এক মুক্তিযোদ্ধার গ্রুপে ১০ জনকে দেয়া হয়েছিলো। তারা ১০জন রাজাকারকেই গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। আমার গ্রুপেও ১০ জনকে নিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে মারা হয়েছে। আবার অনেকেই আমাকে আর্মিদের তথ্য দিতো যে কারণে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারা এখনও জীবিত আছে। সারিয়াকান্দিতেই আছে। এদের মধ্যে অনেককে আর্মিরা জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। বাধ্য করেছিলো তাদের হয়ে কাজ করতে। যে কারণে তাদের ছেড়ে দিই।

এনাম/ফয়সাল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়