ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

ছয় বছরেও রোহিঙ্গাদের মানসিক বিপর্যয় কাটেনি 

তারেকুর রহমান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ফিরে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৭, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২১:৫৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩
ছয় বছরেও রোহিঙ্গাদের মানসিক বিপর্যয় কাটেনি 

রোহিঙ্গা ক্যাম্প

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ৮ লাখ রোহিঙ্গা। নিজ জন্মভূমি, বসতবাড়ি ও ধন-সম্পত্তি হারিয়ে বেকায়দায় পড়েন তারা। বেঁচে থাকার জন‌্য আশ্রয় ও ন‌্যুনতম সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির অধিকাংশরই মানসিক বিপর্যয় কাটেনি গত ছয় বছরেও। 

মিয়ানমারে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ধ্বংসাত্মক ঘটনা, স্বজন-পরিজনের মৃত্যু, আগুনে বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার চিত্র, গুলির শব্দ, জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে দীর্ঘদিন বসবাস এবং নিজ দেশে ফেরার কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পাওয়ায় মানসিক চাপে পড়ে যান তারা। যা তাদেরকে স্থায়ীভাবেই মানসিক বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দিয়েছে। 

মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) সরেজমিন ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, অনেক রোহিঙ্গা উদাস জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কেউ কেউ এখনো সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনেই ফিরতে পারেননি।

জীবনের সঙ্গী মানসিক বিপর্যয়: ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন ৪০ বছর বয়সী আবু ইউসুফ। মিয়ানমারে তার বাড়ি ছিল মঙডুর ব্যানডুলে। কিন্তু রাখাইন সেনাদের অত্যাচারে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে স্বপরিবারে এদেশে পালিয়ে আসেন বলে জানান তিনি। বর্তমানে তিনি থাইংখালীর ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জি-২ ব্লকে থাকেন। পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীসহ ৮ সদস্যের পরিবার তার। সবকিছু ছেড়ে অন্যদেশে পাড়ি জমানোর বিষন্নতা কাটতে না কাটতেই তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। গত ১ বছর ৪ মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করছেন। বালুখালী টিভি টাওয়ার এলাকায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও ডাম্পার ট্রাকের সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। 

আবু ইউসুফ

একদিকে, পঙ্গুত্ব অপরদিকে নিজদেশ ছেড়ে পরবাসী জীবন তাকে চরম হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছে। প্রতিনিয়ত বিপর্যয় ঘটছে চিন্তা চেতনায়। 

আবু ইউসুফ বলেন, ‘এখনো যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে চোখে ভাসে আমার জন্মভূমি মিয়ানমারের পথঘাট। ঘুমাতে পারি না, চোখ বন্ধ করলে মনে পড়ে ব্যানডুল গ্রামে কাটানো শৈশব-যৌবনের কথা। আজ আমরা শরণার্থী। অন্যের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে হচ্ছে। বন্দিজীবন। আবার পঙ্গুও। সবমিলিয়ে মানসিক চিন্তা, চাপ নিজেকে পীড়া দিচ্ছে।’

পরিবারের সঙ্গে আবু আলম

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২ ইস্ট, এ-৪ ব্লকের আবুল আলম বলেন, ‘নিজ জন্মভূমি মন্ডুর নাপ্পুইয়াং এলাকার জন্য কলিজাটা ফেটে যায়। সেখানে আমার গরু-মহিষের পাল ছিল। ধানের ক্ষেত ছিল।। সব ছেড়ে এখানে চলে আসতে হয়েছে। মনের খুশিতে আসিনি। অত্যচার সহ্য করতে না পেরে প্রিয় জন্মভূমি ছেড়েছি। সুযোগ পেলে এখনই চলে যেতাম। দীর্ঘদিন অন্যদেশে থেকে নিজের দেশ আর অন্যের দেশের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারি এখন।’

শরণার্থী জীবনে মানিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই: রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিস্থিতিভেদে কেউ কেউ মানিয়ে নিচ্ছে শরণার্থী জীবন। তারা বুঝতে পারছেন ভেঙে পড়লেও হারানো কিছু ফিরে পাওয়া যাবে না। ক্যাম্পেই হয়তো তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। 

কুতুপালং ক্যাম্প-২/ই এর বাসিন্দা আমির হোসাইন (৮০) বলেন, ‘ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বার বার মনে পড়লে খারাপ লাগে। তাই নির্মম এসব ঘটনা ভুলে যেতে চাই। বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় এবং খাবারের সুযোগ করে দিয়েছে। শরণার্থী জীবনে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছি। পরিবারের অন্যদেরও দুশ্চিন্তা না করার জন্য তাগাদা দেই।’

২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ডব্লিউ-১ ব্লকের মোহছেনা বেগমের (২৭) স্বামী মুহাম্মদ আলম গত ৩ বছর ধরে নিখোঁজ। বাসায় দ্বিতীয় কোনো পুরুষ নেই। ছোট ছোট শিশু সন্তানদের নিয়ে অনিশ্চয়তার জীবনযাপন করছেন তিনি। মোহছেনা বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসার সময় জীবনে এক যুদ্ধ ছিল। এখন পুরুষবিহীন পরিবার নিয়ে আরেক জীবন যুদ্ধে আছি। হতাশায় থাকি সারাক্ষণ। তারপরও প্রতিবেশী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শে নিজেকে অনেকটা মানিয়ে নিয়েছি।’

আমির হোসাইন

একই ক্যাম্পের এ-১ ব্লকের মাঝি নবী হোসেন বলেন, ‘আমার ব্লকের বাসিন্দাদের ভেঙে না পড়ার জন্য বুঝাই। কেউ দুশ্চিন্তা করলে তাকে খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে পরামর্শ পেয়েছি, চিন্তা করলে নিজের ক্ষতি হবে। চিন্তামুক্ত থাকলে রোগমুক্ত থাকবো এমনটা জেনে আর চিন্তা করি না। অন্যকেও চিন্তা করতে দেই না।’ 

স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষার ব্যবস্থা থাকায় স্বস্তি:  বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা চালু করায় অনেকে চিন্তামুক্ত। ক্যাম্প ২ ইস্ট, এ-৪/৩৯ এর বাসিন্দা সাজেদা বেগম বলেন, ‘প্রথমে চিকিৎসাসেবা ও শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু, পরে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার মাধ্যমে ওষুধ, টিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে ঘরে এসে পরামর্শ দিচ্ছেন। শিশুদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল লার্নিং সেন্টার খুলে দিয়েছেন। এতে করে আমরা অনেকটা স্বস্তিতে আছি।’

যেভাবে মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠছে: নিয়মিত চিকিৎসাসেবা, পরামর্শ ও ক্যাম্পিং কার্যক্রম মানসিকভাবে ভেঙে পড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিপর্যয় কাটিয়ে তুলতে সহযোগিতা করছেন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা। 

একটি রোহিঙ্গা পরিবারের ঘরের ভেতরের দৃশ্য

পার্টনার্স ইন হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (পিএইচডি) জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক ডা. মো. দানিয়েল হোসাইন বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত প্রত্যেকজন বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। কারণ, তারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে এদেশে এসেছেন প্রাণ বাঁচানোর জন্য। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানসিক বিপর্যয়ের ব্যাপারটা যখন আমরা বুঝতে পারি তখন তাদের সাইকোলজিক্যাল সাপোর্টের ব্যবস্থা করি। ক্যাম্পে কর্মরত প্রত্যেক কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের আমরা ‘মানসিক হতাশ’ বিষয়ে ট্রেনিং করিয়েছি। তারা সেভাবে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সেবা দিচ্ছেন।”

তিনি আরও বলেন, ‘যারা প্রাথমিকভাবে মানিসক হতাশায় ভোগেন তাদেরকে কীভাবে কাউন্সিলিং করা যায় তা স্বাস্থ্যকর্মীদের আমরা শিখিয়ে দিয়েছি। তারা প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে হতাশা কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। যদি তাতেও কাজ না হয়, তবে তাদের আরো উন্নত সেবা দেওয়ার জন্য হেলথ সেন্টারে পাঠিয়ে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়।’

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, ‘এদেশে প্রবেশের পর তাদের (রোহিঙ্গা) জীবন বাঁচানো প্রথম মানবিক উদ্দেশ্য ছিল আমাদের। পরে তাদেরকে আমরা মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট দেই। কীভাবে তাদের হতাশা দূর করা যায় সে ব্যাপারে আমরা পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ক্যাম্পে আমাদের পার্টনার কিছু এনজিও তাদের স্বাস্থ্যকর্মী হতাশাগ্রস্তদের মানসিক সমর্থন ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের হতাশা দূর করা হচ্ছে।’ ছয় বছরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর হতাশা অনেকাংশ কেটে গেছে বলেও দাবি করেন তিনি।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়