খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ক্যাম্প ‘হামিদা মঞ্জিল’ অরক্ষিত
মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম
বাগমারাস্থ হামিদা মঞ্জিল নিশ্চিহ্ন করে গড়ে তোলা বসতি
লাল-সূর্যের পতাকা ছিনিয়ে আনতে খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করা হয় রূপসা উপজেলার বাগমারাস্থ ‘হামিদা মঞ্জিল’ নামক বাড়িতে। সেখানে বসেই হয় দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনা। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের বিনিময়ে প্রাণপণ চেষ্টায় অর্জিত হয় বিজয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এই ক্যাম্পের কোনো চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত দ্বিতল বিশিষ্ট ওই ভবনটি কয়েক বছর আগে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ভবনসংলগ্ন জমিতে গড়ে উঠেছে বসতি।
এছাড়া, রূপসার দেবীপুরস্থ দুই মুক্তিযোদ্ধার কবর অরক্ষিত। স্মৃতি ধরে রাখতে জায়গা দখলমুক্ত করে ‘হামিদা মঞ্জিল স্মৃতি কমপ্লেক্স ও পাঠাগার’ স্থাপনের পাশাপাশি দুই মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণের দাবি এলাকাবাসীর।
সরেজমিনে দেখা যায়, মহান স্বাধীনতার স্মৃতি বিজড়িত হামিদা মঞ্জিলটি যেখানে অবস্থিত ছিল সেখানে বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানে হামিদা মঞ্জিলের নির্মাতা মরহুম মোসলেম উদ্দীন শেখের মায়ের কবর রয়েছে। কবরের পাশ্ববর্তী ঘরের দেয়ালে ‘হামিদা মঞ্জিল’ লেখা সমৃদ্ধ ছোট একটি প্যানা টাঙানো হয়েছে।
কয়েকবছর আগে একটি প্রভাবশালী মহল দ্বিতলা হামিদা মঞ্জিলটি ভেঙে বিক্রি করে দেয়। এছাড়া, ভবন সংলগ্ন জমি কয়েকজনকে অর্থের বিনিময়ে প্লট আকারে দখল বুঝিয়ে দেয় ওই চক্রটি। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে ইজারা নিয়ে ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করে কয়েকটি পরিবার। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত দেবীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ায় পূর্বের ভবনটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে দাফন করা দুই মুক্তিযোদ্ধা দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির কার্মচারী মো. হাবিবুর রহমান খান ও আনসার সদস্য মোসলেম উদ্দিন হাওলাদারকে। তাদের কবরও সংরক্ষিত নেই।
হামিদা মঞ্জিল নির্মাতার ছেলে অ্যাডভোকেট এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হামিদা মঞ্জিল সংরক্ষণের জন্য তৎকালীন সংসদ সদস্য মোল্লা জালালউদ্দীন ও সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু সংসদে দাবি তোলেন। আমরাও ভবনটি সংরক্ষণের দাবিতে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেও শেষ রক্ষা করতে পারিনি। ২০১১ সালে কতিপয় ভূমিদস্যু রেলওয়ের সঙ্গে যোগসাজসে হামিদা মঞ্জিল ভেঙ্গে বিক্রি করে দেয়। সেখানকার প্রায় এক একর জমিতে অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে।’
দেবীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শেখ জাহিদুল ইসলাম রবি তথ্য দেন, দেবীপুর স্কুলটি ওই স্থান থেকে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রূপসা-বাগেরহাট সড়কের পাশে স্থানান্তর হয়। তার দেয়া তথ্য মতে, প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর জিয়ারত করা হয়। কয়েকবছর পূর্বে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী কবর দুটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। সে উদ্যোগ সফল হয়নি।
দেবীপুরস্থ দুই অরক্ষিত দুই মুক্তিযোদ্ধার কবর
খুলনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের সভাপতি সরদার মাহাবুবার রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃৃতি বিজড়িত স্থান বিলিন হয়ে যাবে এটা কারো কাম্য নয়। সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার দাবি তার।
রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর জাহান বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনাদের মাধ্যমে জেনেছি। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুই মুক্তিযোদ্ধার কবর সংরক্ষণ বিষয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণের জন্য আমাদের কাছে চিঠি আসছে। কবর সংরক্ষণের জন্য পরিবারের সদস্যদের আবেদন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা আবেদন করলে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্মৃতি বিজড়িত হামিদা মঞ্জিল ও দেবীপুর বালিকা বিদ্যালয়:
বীর মুক্তিযোদ্ধা স.ম. বাবর আলী রচিত স্বাধীনতার দূর্জয় অভিযান, দিব্যেন্দু দ্বীপ রচিত গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর, বাগেরহাট জেলা ও কাজী মোতাহার রহমান রচিত খুলনার ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ বই ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ খুলনায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। শহিদ হাদিস পার্ক থেকে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। লোয়ার যশোর রোডস্থ টিএন্ড টি থেকে বেলুচ পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে ৭ জন শহিদ হন। যুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে তৎকালীন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে শহরের কে. ডি. ঘোষ রোড ও কালীবাড়ী এলাকার পাঁচটি বন্দুকের দোকান লুট করে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর খুলনা জেলায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য খানজাহান আলী রোডের কবীর মঞ্জিলে বিপ্লবী পরিষদের কমিটি গঠন হয়। শেখ কামরুজ্জামান টুকু এ পরিষদের চেয়ারম্যান হন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত পরিত্যক্ত দেবীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়
২৬ মার্চ থেকে খুলনা শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর টহল শুরু হলে ২৮ মার্চ নাগাদ শেখ কামরুজ্জামান টুকু অস্ত্র ও যুবকদের নিয়ে রূপসা নদী পার হয়ে রূপসা রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাষ্টারের কক্ষে অবস্থান নেন। পরে অদূরে বাগমারা গ্রামের হামিদা মঞ্জিলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। রেলওয়ের আওতাধীন দ্বিতলা ভবন হামিদা মঞ্জিলে ১০টি কক্ষ ছিল। বাড়িটির নির্মাতা ছিলেন মরহুম মোসলেম উদ্দীন শেখ। স্ত্রীর নামানুসারে বাড়িটির নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে দেবীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে এ মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন। পরে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার অস্ত্রসহ দেবীপুর ক্যাম্পে যোগ দেন। সব মিলিয়ে দুই ক্যাম্পে প্রায় ২৫০ জন সদস্য সংখ্যা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৯ম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল বাগেরহাট সফরে এসে গল্পামারীস্থ বেতার কেন্দ্র দখলের জন্য শেখ কামরুজ্জামান টুকুকে পরামর্শ দেন।
বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ কামরুজ্জামান টুকু ৪ এপ্রিল রাতে গল্লামারীস্থ বেতার কেন্দ্র দখলের সিদ্ধান্ত নেন। বাগেরহাট মহাকুমার চিতলমারী থানার সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মো. শেখ জয়নুল আবেদীনকে যুদ্ধের অধিনায়ক নির্ধারণ করা হয়। রাত ১টা নাগাদ মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি গল্লামারীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নৌকাযোগে রূপসা নদী পার হওয়ার সময় এক যোদ্ধার রাইফেল থেকে গুলি বের হয়ে মাঝির মাথায় লাগলে তিনি প্রাণ হারান।
এই যুদ্ধে অধিনায়ক সুবেদার মেজর শেখ জয়নুল আবেদীন, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির কার্মচারী হাবিবুর রহমান খান ও আনসার সদস্য মোসলেম উদ্দিন হাওলাদার শহিদ হন। যুদ্ধে পিছু হটে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ দেবীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে আসে। এ বিদ্যালয়ের পেছনে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির কর্মচারী ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার বদনীকাটি গ্রামের আশরাফ আলী খানের ছেলে হাবিবুর রহমান খান (গেজেট বই নং-৯৫৯২, ক্র নং-১৩৮) ও বাগেরহাট মহাকুমার মোড়েলগঞ্জ থানার উত্তর হামেদানী হাওলাদারের ছেলে মোসলেম উদ্দিন হাওলাদার (মুক্তিবার্তা নং-০৪০৩০৬০০৮২), (শহিদ গেজেট বই নং-৯৫২১, নং- ১৬৮২)-এর দাফন সম্পন্ন হয়। শহরের শের-ই-বাংলা রোডস্থ সিটি কলেজ ছাত্রাবাসে যুদ্ধের অধিনায়কের দাফন সম্পন্ন হয়।
নৈহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আব্দুল হক বলেন, হামিদা মঞ্জিল ও তার পাশের এক তলা ভবনে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করে। পাশ্ববর্তী হাচেন মোল্লার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল আশ্রয় নেয়।
দেবীপুর গ্রামের প্রয়াত নারায়ন চন্দ্র পালের ছেলে রবিন কুমার পালের ভাষ্য, মুক্তিযোদ্ধারা গল্লামারী যুদ্ধ থেকে পিছু হটে দেবীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৩/৪ দিন অবস্থান করেন। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তারা ভারতের উদ্দেশ্যে দেবীপুর ত্যাগ করেন।
হামিদা মঞ্জিল নির্মাতার ছেলে অ্যাডভোকেট এস এম মোস্তাফিজুর রহমান তথ্য দিয়েছেন, ১৯৬৭ সালে এই সম্পত্তি রেল অধিগ্রহণ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে রেলওয়ের গার্ড কবির ও তার ছেলে স্বপন স্বপরিবারে বসবাস শুরু করেন।
তালিমপুর গ্রামের শহীদ সোহরওয়ার্দী শেখ জানান, তাদের বাড়ির পাশেই হামিদা মঞ্জিল। যুদ্ধের সময় সেখানে একটানা বেশ কয়েকদিন মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন। এরপরে মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া করতেন তারা। তাদের বাড়িতেও কিছু মুক্তিযোদ্ধা থাকতেন।
মাসুদ